জামাল উদ্দিন খান। হবু ইঞ্জিনিয়ার। আমার খুব কাছের বন্ধু। খুব দ্রুত সে ফুল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হতে যাচ্ছে।
আমি যদি কোনোদিন পৃথিবীর শুদ্ধতম কিছু মানুষের তালিকা করি জামাল সে তালিকার একদম প্রথম দিকে থাকবে।
জামাল থাকে ঢাকায়, আমি সিলেট। আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হয় কম। যা কথাবার্তা সব ফোনেই হয়। আমি যতোক্ষণ তাঁর সাথে কথা বলি ততোক্ষণ এক ধরণের পবিত্রতা অনুভব করি। শুদ্ধ মানুষের কথা শুনলেও নাকি পূন্য হয়। আমি ফোনেই পূন্য অর্জন করার চেষ্টা করি।
জামালের সাথে কথা বলার সময় আরেকটা জিনিষ কাজ করে। সেটা হলো ভয়।
টেকনোলজি নিয়ে এই মানুষটার অগাধ জ্ঞান। প্রযুক্তি সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান আছে এরকম কোনো তালিকা থাকলে সেই তালিকাতেও জামালের নাম প্রথম দিকে থাকবে বলে আমার ধারণা।
কথা বলার সময় ভয় কেনো কাজ করে একটু বলি।
হবু ইঞ্জিনিয়ারের সাথে যখনই আড্ডা দেই দেখা যায় প্রসঙ্গ কোনো না কোনোভাবে টেকনোলজির দিকে চলে যাচ্ছে। আর ঐ দিকে কথা চলে যাওয়া মানে আড্ডা আমার নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাওয়া। কথা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই জামাল কিম্ভুৎকিমাকার সব টেকি শব্দ ব্যবহার করা শুরু করে দেয়। আমি তখন হাঁ করে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকি আর মাঝে মাঝে খুব জোরে মাথা নাড়াই। মনে হয় যেনো সব বুঝে ফেলেছি। আমার মাথা নাড়ানো দেখে জামাল দ্বিগুন উৎসাহে টেকনোলজি বিষয়ক বয়ান দিতে থাকে। আমার হা-র পরিধীও আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে।
যাই হোক। জামাল আর আমি একই সাথে ব্লগিং শুরু করেছিলাম। তখন আমাদের দুজনের চোখেই আকাশ সমান স্বপ্ন। ব্লগিং করে সমাজ বদলে দেবো, পুজিবাদী এই সমাজ ব্যাবস্থার সব সমস্যার মূলে কুঠারাঘাত করবো, সম্রাজ্যবাদীদের মুখোশ উন্মোচন করবো, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনৈতিক পশ্চাতপদতার কারণ তুলে ধরবো ইত্যাদি ইত্যাদি।
এইসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা দুজনেই সামহোয়্যারইন ব্লগে লেখা শুরু করলাম।
বলা বাহুল্য আমাদের পোস্টগুলো খুব একটা পাত্তা পেলো না। মানে পাঠকরা পাত্তা টাত্তা দিলো না। না দেয়াই স্বাভাবিক। বাঙালি জাতি সিরিয়াস ব্যাপার পাত্তা দেয়না। আমাদের 'অর্থনৈতিক দৈন্যদশা এবং ইরাক মধ্যপ্রাচ্য শান্তিচুক্তি' শিরোনামের পোস্টের চেয়ে সবার কাছে 'আইজ প্রভার ভিডিও বাইর হইছে' টাইপ পোস্টেরই পাঠক বেশি।
আমি আর জামাল দুজনেই তখন হতাশ। ম্রিয়মান গলা নিয়ে তবুও আমরা আড্ডা মেরে যাই।
একদিন জামাল খুব উৎসাহ নিয়ে আমাকে ফোন করলো। আমাদের কথোপকথন ছিলো মোটামোটি এরকমঃ
জামালঃ রাজি, ওয়ার্ডপ্রেসে লেখালেখি করা উচিত আমাদের।
রাজিঃ আরে তাই তো!
জামালঃ ওয়ার্ডপ্রেস কিন্তু দারুন জিনিষ।
রাজিঃ আরে তাই তো!
জামালঃ তাদের অনেক ফিচার।
রাজিঃ তা তো বটেই।
জামালঃ ইন্টারফেস, থিম, প্লাগইন, সবকিছু একেবারে অসাধারণ।
রাজিঃ নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই।
জামালঃ তাহলে ঐ কথাই রইলো। আমরা ওয়ার্ডপ্রেসে মুভ করবো। তোমার কোনো জিজ্ঞাসা থাকলে বলো। বুঝিয়ে দেই।
রাজিঃ ইয়ে মানে... ওয়ার্ডপ্রেস কিতা?
আমার প্রশ্ন শুনে জামাল মনে হলো একটু হতাশ হলো। তারপরেও আমাকে খুব উৎসাহের সাথে ওয়ার্ডপ্রেস সম্পর্কে জ্ঞান দিলো। বলা বাহুল্য এগুলোর কিছুই আমার মাথায় ঢুকলো না।
তারপর অনেক চন্দ্রভূক অমবস্যা কেটে গেলো। আমি সামহোয়্যারইনব্লগে লেখালেখি চালিয়ে যেতে লাগলাম। খুব দ্রুত নিজেকে আবিষ্কার করলাম একজন ফাজিল লেখক হিসেবে। যে কিনা ফাজলামী মার্কা পোস্ট ছাড়া কিছুই আর লিখতে পারেনা।
আমাকে অবাক করে দিয়ে সহব্লগাররা আমার ফাজলামীমার্কা পোস্টগুলোকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখলেন। নিয়মিত পড়ে কমেন্ট করে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করলেন। খুব দ্রুত আমি সামহোয়্যারইনব্লগের প্রেমে পড়ে গেলাম। এবং ব্লগিং আক্ষরিক অর্থেই একটা নেশা হয়ে গেলো।
আমার একটা বদ অভ্যাস আছে। কোনোকিছুর প্রতিই খুব বেশিদিন আমার খুব একটা আগ্রহ থাকে না। ব্লগের ক্ষেত্রেও তাই ঘটলো। যেভাবে ধীরে ধীরে ব্লগের প্রেমে পড়েছিলাম সেভাবে আস্তে আস্তে ব্লগের সাথে একটা দুরত্ব তৈরি হলো। অবশ্য এমনি এমনি হয়নি এটা। অনেকগুলো কারনেই হয়েছে।
প্রথম কারণ হলো সময় স্বল্পতা। ব্লগিং করতে হলে দরকার পাইকারী সময়। আমার সময় খুব দ্রুত খুচরা হয়ে যেতে লাগলো।
আরেকটা কারণ হলো ব্লগের প্রতি বিরক্তি। কিছু কারণে সামহোয়্যারইনব্লগের উপর বিরক্ত ছিলাম অনেক। কিছুদিন আগে বিরক্তিটা চরম আকার ধারণ করলো যখন দেখলাম জাফর ইকবাল স্যারের মেয়েকে নিয়ে ব্লগে অসম্ভব নোংরামী শুরু হলো। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম এই ব্যাপারে মডারেশনও নির্বিকার। তখন মনে হলো 'ধুর! এই বালের ব্লগিং না করলে কী হয়?'
ব্লগস্পটে এই সাইটটা বানিয়ে রেখেছিলাম সামহোয়্যারইনব্লগে অনিয়মিত হয়ে যাবার আগেই।
সংক্ষেপে বলা যাক ঘটনাটা।
কোনো এক রাবিন্দ্রীক সকালে আমার জামালের কথা মনে পড়লো। জামাল বলেছিলো ব্যাক্তিগত ব্লগের কথা। আমি ঐ লাইনে না যাওয়ায় সে একাই ব্লগ বানিয়েছে।
আমি গেলাম জামালের ব্লগে। জামালের ব্লগ 'ফিনিক্স পাখির বাসা' দেখে আমি মুগ্ধ হলাম।
আমার টেকি জ্ঞান শূন্যের কাছাকাছি। জামালের ব্লগ দেখে নিজের ক্ষুদ্র জ্ঞান নিয়েও আমি দাঁড়িয়ে গেলাম - আমাকেও একটা বানাতে হবে।
শুভ কাজে দেরি করতে নেই। আমি তৎক্ষনাত ব্লগ বানাতে নেমে পড়লাম।
আমার তখন 'ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার' টাইপ অবস্থা। মানে কোনো বেসিক জ্ঞানই নেই।
দারস্থ হলাম গুগলের। তখন পর্যন্ত আমার ধারনা কেবল ওয়ার্ডপ্রেস দিয়েই সাইট বানানো সম্ভব। কিন্তু গুগল স্বজনপ্রীতি দেখিয়ে আমাকে বললো 'না হে বালক। আমাদের সার্ভিস নাও। ব্লগার দিয়ে আরো ভালো সাইট বানানো যায়'
আমি আনাড়ি বালক। গুগলের কথাই নমসঃ মেনে কাজ শুরু করে দিলাম। বানিয়ে ফেললাম এই ব্লগ। বানিয়ে ফেলা মানে রেজিষ্ট্রেশন করা পর্যন্তই। এর বাইরে ডিজাইন নিয়ে কাজ করতে আমার সাহসে কুলালো না। বানিয়ে ওভাবেই রেখে দিলাম।
২০১১ সালের জুলাই এর ঘটনা। আমার জীবনে বড় ধরনের একটা পরিবর্তন আসলো। আবেগের ডানায় উড়তে থাকা রাজি আছড়ে পড়লো পাটিতে।
ক্রুয়েল রিয়েলিটি সম্পর্কে ধারণা লাভ করলাম। শিক্ষা পেলাম - জীবনকে আমি যতো সহজভাবে দেখি জীবন আসলে পুরোটাই তার বিপরীত।
খুব খারাপ ছিলো সে সময়টা। কিছু না করে চুপচাপ এক যায়গায় বসে থাকতে পারতাম না। চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াটাই ভালো মনে হতো। আমার অসম্ভব রকমের বই পড়ার নেশা আছে। কিন্তু ঐসময় বই পড়াও অসহ্য লাগছিলো। প্রফ পরীক্ষা শেষ। পড়ালেখাও নেই। অসহ্য লাগে সবকিছু।
একদিন হঠাৎ কম্পিউটারের সামনে বসে ব্লগস্পট সাইটটা খুললাম। ভাবলাম এটাকে ডিজাইন করতে পারলে মন্দ হয়না। ডিজাইন করাটা আমার মতো আনাড়ির জন্য বেশ জটিল কাজই বটে। জটিল সব কোড দিয়ে টেম্পলেট সাজানো। বেশ মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে হয়। কাজ করতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করলাম অসহ্য অনুভূতিগুলো থেকে অনেকটাই দূরে থাকা যাচ্ছে!
আমি খুব উৎসাহ নিয়ে এটাকে ডিজাইন করতে বসলাম।
অনেক খেটেখুটে একটা সাইজ দাড় করাই। পছন্দ না হলে ডিলিট করি। আবার প্রথম থেকে শুরু করি। ছোট থাকতে যেমন বালু ঘর বানিয়ে আবার ভেঙ্গে ফেলতাম অনেকটা সেরকম। আমি ছেলেমানুষি আনন্দ নিয়ে এটাক সাজাতে লাগলাম।
কয়েকদিন টানা HTML নিয়ে খাটাখাটি করার পর একটা টেম্পলেট পছন্দ হলো। বলে রাখি মুল টেম্পলেটগুলো আমার বানানো ছিলো না। নেটে পেয়ে পরে নিজের মতো সাজিয়ে নিয়েছিলাম।
ব্লগের একটা নাম দিলাম - 'খেয়ালিকা'
খুব যে চিন্তাভাবনা করে দিয়েছে তা না। হঠাৎ মনে আসলো, দিয়ে দিলাম।
আনাড়ি হাতে ডিজাইন করা এই ব্লগটা অনেকেই পছন্দ করলেন। আমি উৎসাহ পেলাম।
আস্তে আস্তে সামহোয়্যারইনব্লগ সহ অন্যসব যায়গা থেকে সব লেখা এনে জড়ো করলাম এখানে। ততোদিন সামহোয়্যারইন-এর সাথে দুরত্ব তৈরি হয়ে গেছে অনেক। আমি এটাতেই পোস্ট করতে থাকলাম।
কমেন্টের নিচে ফেসবুক থেকে কমেন্ট করার একটা সিস্টেম রাখলাম।
কিছুদিনের মধ্যেই আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম - ব্লগস্পটের কোনায় করা এই ব্লগটাতে ভালোই হিট পড়ছে। দৈনিক তিন চারশো। একদিন ব্লগে একটা পোস্ট দিলাম - “এ জার্নি বাই বাস” রচনাটি এখন যেভাবে লেখা উচিত (উৎসর্গঃ যোগাযোগমন্ত্রী)
খুব হালকা মেজাজের একটা লেখা। লিখে ফেসবুকে শেয়ার দিলাম। তারপর আমার অবাক হওয়ার পালা। পাঠক এই লেখাটাকে এতোবার শেয়ার করলেন যে মাত্র দুই দিনে এটার পাঠক সংখ্যা গিয়ে দাড়ালো ৫ হাজারে। আমার খুশি দেখে কে! এলেক্সা রেটিং-ও এক ধাক্কায় এগিয়ে গেলো অনেক।
মোটামোটি নিয়মিতই লিখতে থাকলাম এখানে। পাঠক আসতে লাগলেন ভালোই। দৈনিক গড়ে ৮০০/৯০০।
কিন্তু পড়ালেখা নিয়ে একটু দৌড়ের উপর থাকায় তিনমাসের জন্য পিসিতে নেট কানেকশন অফ করে দিলাম। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী। লিখিনি কিছুই ততোদিন। পাঠকও আস্তে আস্তে কমতে লাগলো। ব্লগটার প্রতি আমার নিজেরও টান কমে গেলো অনেক।
ফেব্রুয়ারীতে আবার নেট নিলাম। আবার লিখলাম। আবার এপ্রিলে নেট কেটে দিলাম। এভাবেই চলছে ব্লগর ব্লগর। :)
গত সপ্তাহে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। শাওনকে একটু শান্তিতে থাকতে দিন প্লিজ
৫/৬ দিনে এটা পঠিত হয়েছে ১২৬০০ বার। এটা এখন পর্যন্ত এই ব্লগের সবচেয়ে বেশিবার পঠিত লেখা।
গত পরশু খেয়াল করলাম হিট ১ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এলেক্সার রিজিওনাল রেটিং আজ দেখাচ্ছ ২৫৯৫। দেখে ভালো লাগলো। ব্লগস্পটের সাইট মানে নির্জন মরুভুমিতে কুড়ে ঘরের মতো ব্যাপার। এই কুড়ে ঘরে ১ লক্ষবার মানুষ এসেছে! আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ।
অনেকক্ষন বক বক করলাম।
এই বড়লেখা কেউ পড়বে না জানি। তারপরেও কেউ যদি পড়ে ফেলেন - তাহলে ধরে নেবো আমি ভাগ্যবান। অসম্ভব ভাগ্যবান।
আমি কৃতজ্ঞ আপনার কাছে - আপনি এই লেখাটি পড়েছেন বলে। আমি কৃতজ্ঞ আপনার কাছে আনাড়ি হাতের এই লেখাগুলো পড়ে সজ্ঞানে অথবা অজ্ঞানে আমাকে আস্কারা দিয়েছেন বলে।
:)
আমি যদি কোনোদিন পৃথিবীর শুদ্ধতম কিছু মানুষের তালিকা করি জামাল সে তালিকার একদম প্রথম দিকে থাকবে।
জামাল থাকে ঢাকায়, আমি সিলেট। আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হয় কম। যা কথাবার্তা সব ফোনেই হয়। আমি যতোক্ষণ তাঁর সাথে কথা বলি ততোক্ষণ এক ধরণের পবিত্রতা অনুভব করি। শুদ্ধ মানুষের কথা শুনলেও নাকি পূন্য হয়। আমি ফোনেই পূন্য অর্জন করার চেষ্টা করি।
জামালের সাথে কথা বলার সময় আরেকটা জিনিষ কাজ করে। সেটা হলো ভয়।
টেকনোলজি নিয়ে এই মানুষটার অগাধ জ্ঞান। প্রযুক্তি সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান আছে এরকম কোনো তালিকা থাকলে সেই তালিকাতেও জামালের নাম প্রথম দিকে থাকবে বলে আমার ধারণা।
কথা বলার সময় ভয় কেনো কাজ করে একটু বলি।
হবু ইঞ্জিনিয়ারের সাথে যখনই আড্ডা দেই দেখা যায় প্রসঙ্গ কোনো না কোনোভাবে টেকনোলজির দিকে চলে যাচ্ছে। আর ঐ দিকে কথা চলে যাওয়া মানে আড্ডা আমার নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাওয়া। কথা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই জামাল কিম্ভুৎকিমাকার সব টেকি শব্দ ব্যবহার করা শুরু করে দেয়। আমি তখন হাঁ করে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকি আর মাঝে মাঝে খুব জোরে মাথা নাড়াই। মনে হয় যেনো সব বুঝে ফেলেছি। আমার মাথা নাড়ানো দেখে জামাল দ্বিগুন উৎসাহে টেকনোলজি বিষয়ক বয়ান দিতে থাকে। আমার হা-র পরিধীও আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে।
যাই হোক। জামাল আর আমি একই সাথে ব্লগিং শুরু করেছিলাম। তখন আমাদের দুজনের চোখেই আকাশ সমান স্বপ্ন। ব্লগিং করে সমাজ বদলে দেবো, পুজিবাদী এই সমাজ ব্যাবস্থার সব সমস্যার মূলে কুঠারাঘাত করবো, সম্রাজ্যবাদীদের মুখোশ উন্মোচন করবো, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনৈতিক পশ্চাতপদতার কারণ তুলে ধরবো ইত্যাদি ইত্যাদি।
এইসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা দুজনেই সামহোয়্যারইন ব্লগে লেখা শুরু করলাম।
বলা বাহুল্য আমাদের পোস্টগুলো খুব একটা পাত্তা পেলো না। মানে পাঠকরা পাত্তা টাত্তা দিলো না। না দেয়াই স্বাভাবিক। বাঙালি জাতি সিরিয়াস ব্যাপার পাত্তা দেয়না। আমাদের 'অর্থনৈতিক দৈন্যদশা এবং ইরাক মধ্যপ্রাচ্য শান্তিচুক্তি' শিরোনামের পোস্টের চেয়ে সবার কাছে 'আইজ প্রভার ভিডিও বাইর হইছে' টাইপ পোস্টেরই পাঠক বেশি।
আমি আর জামাল দুজনেই তখন হতাশ। ম্রিয়মান গলা নিয়ে তবুও আমরা আড্ডা মেরে যাই।
একদিন জামাল খুব উৎসাহ নিয়ে আমাকে ফোন করলো। আমাদের কথোপকথন ছিলো মোটামোটি এরকমঃ
জামালঃ রাজি, ওয়ার্ডপ্রেসে লেখালেখি করা উচিত আমাদের।
রাজিঃ আরে তাই তো!
জামালঃ ওয়ার্ডপ্রেস কিন্তু দারুন জিনিষ।
রাজিঃ আরে তাই তো!
জামালঃ তাদের অনেক ফিচার।
রাজিঃ তা তো বটেই।
জামালঃ ইন্টারফেস, থিম, প্লাগইন, সবকিছু একেবারে অসাধারণ।
রাজিঃ নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই।
জামালঃ তাহলে ঐ কথাই রইলো। আমরা ওয়ার্ডপ্রেসে মুভ করবো। তোমার কোনো জিজ্ঞাসা থাকলে বলো। বুঝিয়ে দেই।
রাজিঃ ইয়ে মানে... ওয়ার্ডপ্রেস কিতা?
আমার প্রশ্ন শুনে জামাল মনে হলো একটু হতাশ হলো। তারপরেও আমাকে খুব উৎসাহের সাথে ওয়ার্ডপ্রেস সম্পর্কে জ্ঞান দিলো। বলা বাহুল্য এগুলোর কিছুই আমার মাথায় ঢুকলো না।
তারপর অনেক চন্দ্রভূক অমবস্যা কেটে গেলো। আমি সামহোয়্যারইনব্লগে লেখালেখি চালিয়ে যেতে লাগলাম। খুব দ্রুত নিজেকে আবিষ্কার করলাম একজন ফাজিল লেখক হিসেবে। যে কিনা ফাজলামী মার্কা পোস্ট ছাড়া কিছুই আর লিখতে পারেনা।
আমাকে অবাক করে দিয়ে সহব্লগাররা আমার ফাজলামীমার্কা পোস্টগুলোকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখলেন। নিয়মিত পড়ে কমেন্ট করে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করলেন। খুব দ্রুত আমি সামহোয়্যারইনব্লগের প্রেমে পড়ে গেলাম। এবং ব্লগিং আক্ষরিক অর্থেই একটা নেশা হয়ে গেলো।
আমার একটা বদ অভ্যাস আছে। কোনোকিছুর প্রতিই খুব বেশিদিন আমার খুব একটা আগ্রহ থাকে না। ব্লগের ক্ষেত্রেও তাই ঘটলো। যেভাবে ধীরে ধীরে ব্লগের প্রেমে পড়েছিলাম সেভাবে আস্তে আস্তে ব্লগের সাথে একটা দুরত্ব তৈরি হলো। অবশ্য এমনি এমনি হয়নি এটা। অনেকগুলো কারনেই হয়েছে।
প্রথম কারণ হলো সময় স্বল্পতা। ব্লগিং করতে হলে দরকার পাইকারী সময়। আমার সময় খুব দ্রুত খুচরা হয়ে যেতে লাগলো।
আরেকটা কারণ হলো ব্লগের প্রতি বিরক্তি। কিছু কারণে সামহোয়্যারইনব্লগের উপর বিরক্ত ছিলাম অনেক। কিছুদিন আগে বিরক্তিটা চরম আকার ধারণ করলো যখন দেখলাম জাফর ইকবাল স্যারের মেয়েকে নিয়ে ব্লগে অসম্ভব নোংরামী শুরু হলো। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম এই ব্যাপারে মডারেশনও নির্বিকার। তখন মনে হলো 'ধুর! এই বালের ব্লগিং না করলে কী হয়?'
ব্লগস্পটে এই সাইটটা বানিয়ে রেখেছিলাম সামহোয়্যারইনব্লগে অনিয়মিত হয়ে যাবার আগেই।
সংক্ষেপে বলা যাক ঘটনাটা।
কোনো এক রাবিন্দ্রীক সকালে আমার জামালের কথা মনে পড়লো। জামাল বলেছিলো ব্যাক্তিগত ব্লগের কথা। আমি ঐ লাইনে না যাওয়ায় সে একাই ব্লগ বানিয়েছে।
আমি গেলাম জামালের ব্লগে। জামালের ব্লগ 'ফিনিক্স পাখির বাসা' দেখে আমি মুগ্ধ হলাম।
আমার টেকি জ্ঞান শূন্যের কাছাকাছি। জামালের ব্লগ দেখে নিজের ক্ষুদ্র জ্ঞান নিয়েও আমি দাঁড়িয়ে গেলাম - আমাকেও একটা বানাতে হবে।
শুভ কাজে দেরি করতে নেই। আমি তৎক্ষনাত ব্লগ বানাতে নেমে পড়লাম।
আমার তখন 'ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার' টাইপ অবস্থা। মানে কোনো বেসিক জ্ঞানই নেই।
দারস্থ হলাম গুগলের। তখন পর্যন্ত আমার ধারনা কেবল ওয়ার্ডপ্রেস দিয়েই সাইট বানানো সম্ভব। কিন্তু গুগল স্বজনপ্রীতি দেখিয়ে আমাকে বললো 'না হে বালক। আমাদের সার্ভিস নাও। ব্লগার দিয়ে আরো ভালো সাইট বানানো যায়'
আমি আনাড়ি বালক। গুগলের কথাই নমসঃ মেনে কাজ শুরু করে দিলাম। বানিয়ে ফেললাম এই ব্লগ। বানিয়ে ফেলা মানে রেজিষ্ট্রেশন করা পর্যন্তই। এর বাইরে ডিজাইন নিয়ে কাজ করতে আমার সাহসে কুলালো না। বানিয়ে ওভাবেই রেখে দিলাম।
২০১১ সালের জুলাই এর ঘটনা। আমার জীবনে বড় ধরনের একটা পরিবর্তন আসলো। আবেগের ডানায় উড়তে থাকা রাজি আছড়ে পড়লো পাটিতে।
ক্রুয়েল রিয়েলিটি সম্পর্কে ধারণা লাভ করলাম। শিক্ষা পেলাম - জীবনকে আমি যতো সহজভাবে দেখি জীবন আসলে পুরোটাই তার বিপরীত।
খুব খারাপ ছিলো সে সময়টা। কিছু না করে চুপচাপ এক যায়গায় বসে থাকতে পারতাম না। চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াটাই ভালো মনে হতো। আমার অসম্ভব রকমের বই পড়ার নেশা আছে। কিন্তু ঐসময় বই পড়াও অসহ্য লাগছিলো। প্রফ পরীক্ষা শেষ। পড়ালেখাও নেই। অসহ্য লাগে সবকিছু।
একদিন হঠাৎ কম্পিউটারের সামনে বসে ব্লগস্পট সাইটটা খুললাম। ভাবলাম এটাকে ডিজাইন করতে পারলে মন্দ হয়না। ডিজাইন করাটা আমার মতো আনাড়ির জন্য বেশ জটিল কাজই বটে। জটিল সব কোড দিয়ে টেম্পলেট সাজানো। বেশ মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে হয়। কাজ করতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করলাম অসহ্য অনুভূতিগুলো থেকে অনেকটাই দূরে থাকা যাচ্ছে!
আমি খুব উৎসাহ নিয়ে এটাকে ডিজাইন করতে বসলাম।
অনেক খেটেখুটে একটা সাইজ দাড় করাই। পছন্দ না হলে ডিলিট করি। আবার প্রথম থেকে শুরু করি। ছোট থাকতে যেমন বালু ঘর বানিয়ে আবার ভেঙ্গে ফেলতাম অনেকটা সেরকম। আমি ছেলেমানুষি আনন্দ নিয়ে এটাক সাজাতে লাগলাম।
কয়েকদিন টানা HTML নিয়ে খাটাখাটি করার পর একটা টেম্পলেট পছন্দ হলো। বলে রাখি মুল টেম্পলেটগুলো আমার বানানো ছিলো না। নেটে পেয়ে পরে নিজের মতো সাজিয়ে নিয়েছিলাম।
ব্লগের একটা নাম দিলাম - 'খেয়ালিকা'
খুব যে চিন্তাভাবনা করে দিয়েছে তা না। হঠাৎ মনে আসলো, দিয়ে দিলাম।
আনাড়ি হাতে ডিজাইন করা এই ব্লগটা অনেকেই পছন্দ করলেন। আমি উৎসাহ পেলাম।
আস্তে আস্তে সামহোয়্যারইনব্লগ সহ অন্যসব যায়গা থেকে সব লেখা এনে জড়ো করলাম এখানে। ততোদিন সামহোয়্যারইন-এর সাথে দুরত্ব তৈরি হয়ে গেছে অনেক। আমি এটাতেই পোস্ট করতে থাকলাম।
কমেন্টের নিচে ফেসবুক থেকে কমেন্ট করার একটা সিস্টেম রাখলাম।
কিছুদিনের মধ্যেই আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম - ব্লগস্পটের কোনায় করা এই ব্লগটাতে ভালোই হিট পড়ছে। দৈনিক তিন চারশো। একদিন ব্লগে একটা পোস্ট দিলাম - “এ জার্নি বাই বাস” রচনাটি এখন যেভাবে লেখা উচিত (উৎসর্গঃ যোগাযোগমন্ত্রী)
খুব হালকা মেজাজের একটা লেখা। লিখে ফেসবুকে শেয়ার দিলাম। তারপর আমার অবাক হওয়ার পালা। পাঠক এই লেখাটাকে এতোবার শেয়ার করলেন যে মাত্র দুই দিনে এটার পাঠক সংখ্যা গিয়ে দাড়ালো ৫ হাজারে। আমার খুশি দেখে কে! এলেক্সা রেটিং-ও এক ধাক্কায় এগিয়ে গেলো অনেক।
মোটামোটি নিয়মিতই লিখতে থাকলাম এখানে। পাঠক আসতে লাগলেন ভালোই। দৈনিক গড়ে ৮০০/৯০০।
কিন্তু পড়ালেখা নিয়ে একটু দৌড়ের উপর থাকায় তিনমাসের জন্য পিসিতে নেট কানেকশন অফ করে দিলাম। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী। লিখিনি কিছুই ততোদিন। পাঠকও আস্তে আস্তে কমতে লাগলো। ব্লগটার প্রতি আমার নিজেরও টান কমে গেলো অনেক।
ফেব্রুয়ারীতে আবার নেট নিলাম। আবার লিখলাম। আবার এপ্রিলে নেট কেটে দিলাম। এভাবেই চলছে ব্লগর ব্লগর। :)
গত সপ্তাহে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। শাওনকে একটু শান্তিতে থাকতে দিন প্লিজ
৫/৬ দিনে এটা পঠিত হয়েছে ১২৬০০ বার। এটা এখন পর্যন্ত এই ব্লগের সবচেয়ে বেশিবার পঠিত লেখা।
গত পরশু খেয়াল করলাম হিট ১ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এলেক্সার রিজিওনাল রেটিং আজ দেখাচ্ছ ২৫৯৫। দেখে ভালো লাগলো। ব্লগস্পটের সাইট মানে নির্জন মরুভুমিতে কুড়ে ঘরের মতো ব্যাপার। এই কুড়ে ঘরে ১ লক্ষবার মানুষ এসেছে! আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ।
অনেকক্ষন বক বক করলাম।
এই বড়লেখা কেউ পড়বে না জানি। তারপরেও কেউ যদি পড়ে ফেলেন - তাহলে ধরে নেবো আমি ভাগ্যবান। অসম্ভব ভাগ্যবান।
আমি কৃতজ্ঞ আপনার কাছে - আপনি এই লেখাটি পড়েছেন বলে। আমি কৃতজ্ঞ আপনার কাছে আনাড়ি হাতের এই লেখাগুলো পড়ে সজ্ঞানে অথবা অজ্ঞানে আমাকে আস্কারা দিয়েছেন বলে।
:)
word press blog এ আসুন...
উত্তরমুছুনঅভ্যস্থ হয়ে গেছি ব্লগারে। ওয়ার্ডপ্রেসে গেলে আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। :)
মুছুন