ডাক্তারের কথা ছিলো পুরোপুরি 'বেড রেস্টে' থাকতে হবে। নাহলে আমার 'খবর আছে'। আমি ডাক্তারের কথা খুব ভালোভাবে শুনেছি। যখন আমার বেড রেস্টে থাকার কথা তখন আমি বাংলাদেশের এক মাথা থেকে আরেক মাথা চক্কর দিয়ে ফেলেছি। টেকনাফ থেকে জাফলং পর্যন্ত।
এই দীর্ঘ ভ্রমনে অভিজ্ঞতা ঝুলিতে বেশ অভিজ্ঞতা জমা হয়েছে। এতো অভিজ্ঞতা হয়েছে যে আমি আসলে কনফিউজড। এই অভিজ্ঞতাগুলো কীভাবে লিখবো? ব্লগের জন্য লিখবো? নাকি পত্রিকার ভ্রমন পাতায় বা রস আলোতে লিখবো?
এই ভ্রমনে দূর থেকে ইন্ডিয়া ও মায়ানমার দুইটা দেশও কিছুটা দেখা হয়েছে। এই দুটা দেশই কুটনৈতিক দিক থেকে আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই একবার ভাবছিলাম সম্পাদকীয় পাতায় 'প্রতিবেশী দুই দেশের সাথে আমার পররাষ্ট্রনীতি কেমন হওয়া উচিত' এই শিরোনামে কিছু কলামও লেখা যেতে পারে।
যাই হোক! শেষ পর্যন্ত ব্লগেই আসলাম ঘুরে ফিরে।
জীবনে কোনো ধারাবাহিক শেষ করতে পারিনি। আশা করছি এইটাও শেষ হবে না। তবে চেষ্টা করতে দোষ কী?
প্রথমে ভেবেছিলাম 'প্রথম পর্ব' লিখবো আজ। পরে ভাবলাম হুট করে প্রথম পর্বে চলে গেলে অনেকে অনেক কিছু বুঝবেন না। তাই 'মাইনাস ওয়ান' পর্ব থেকে শুরু করলাম। আপাতত মনে হবে গ্যাজাচ্ছি। পরে হয়তো এগুলোর সাথে আমার 'দেশ ভ্রমনের' বেশ কিছু সম্পর্ক পাওয়া যেতে পারে। যাই হোক শুরু...
প্রথমে ভেবেছিলাম 'প্রথম পর্ব' লিখবো আজ। পরে ভাবলাম হুট করে প্রথম পর্বে চলে গেলে অনেকে অনেক কিছু বুঝবেন না। তাই 'মাইনাস ওয়ান' পর্ব থেকে শুরু করলাম। আপাতত মনে হবে গ্যাজাচ্ছি। পরে হয়তো এগুলোর সাথে আমার 'দেশ ভ্রমনের' বেশ কিছু সম্পর্ক পাওয়া যেতে পারে। যাই হোক শুরু...
এক স্যার একবার একটা কথা বলেছিলেন, ৮৭ পার্সেন্ট
মানুষের ব্যাক পেইন আছে। বাকি ১৩ পার্সেন্টের কম্পিউটার নেই। কথাটা খুব পছন্দ হয়েছিলো। তাই ব্যাক পেইনকে খুব
একটা পাত্তা দিলাম না। ৮৭ পার্সেন্ট মানুষের যে গতি আমারও সেই গতি। তাছাড়া আমি এককালে ঘন্টার পর ঘন্টা কম্পিউটারের
সামনে বসে কাটিয়ে দিতাম। আমার ব্যাক পেইন হবে না তো কার হবে?
ভেবেছিলাম ব্যাথাকে পাত্তা দেবো না। ব্যাথা করলে করুক। আমি ব্যাথার চিন্তা
মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম। কিন্তু আমি ছাড়লে কী হবে, ব্যাথা আমাকে ছাড়লো
না।
প্রচন্ড ব্যাথা একদিন
মেরুদন্ড থেকে শিফট করলো ডান পায়ের দিকে। মেরুদন্ডে কোনো ব্যাথা নেই কিন্তু পায়ে সাংঘাতিক ব্যাথা। ফুল একটা স্টেপ নিতে
জান বেরিয়ে যায় - এমন অবস্থা। তাও পাত্তা দিলাম না। 'প্যারাসিটামল দুই বেলা' থেরাপি নিয়ে চলে যাচ্ছিলো দিন।
একদিন সকালে উঠে দেখি হাটতে পারি না। ডান পা তোলার চেষ্টা করলে মনে হয় পা
টা কেউ করাত দিয়ে কেটে ফেলছে। এই যখন অবস্থা তখন বাবা জোর করে নিয়ে গেলেন এক অর্থপেডিক সার্জনের
কাছে।
অর্থপেডিক সার্জন আমার স্যার। স্যার আন্তর্যাতিক
খ্যাতি সম্পন্ন চিকিৎসক। খুব রাগী মানুষ। চেহারাতেও রাগের ছাপ স্পষ্ঠ। আমার এমনিতেই স্যারদের
সামনে গেলে গলার পানি শুকিয়ে যায়। এবারও তাই হলো। স্যার আমাকে বললেন বেডে শুয়ে পড়তে। আমি শুয়ে পড়লাম।
স্যার অনেকক্ষণ আমার পা নিয়ে টানাটানি করলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস
ফেলে বললেন 'তোমার অবস্থা তো খারাপ! খুব খারাপ!'
আমি শুকনা মুখ করে বললাম, 'স্যার! কী হয়েছে?'
স্যার আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বিরাট
এক ধমক দিলেন। 'এতোদিন ধরে ব্যাথা নিয়ে ঘুরতেছো। আগে আসলা না কেনো আমার কাছে? এখন তো দিছো বারোটা বাজাইয়া।'
আমি আর পালটা প্রশ্ন করার সাহস পেলাম না। আমার বাবা জিজ্ঞেস
করলেন, 'স্যার! খারাপ কিছু?'
বাবার প্রশ্নে স্যার আমাকে বোঝানো শুরু করলেন-
'তোমার যেটা হয়েছে সেটা হলো 'প্রলাপসড লাম্বার ইন্টারভার্টিব্রাল
ডিস্ক'। লাম্বার ফোর ফাইভের মাঝখানের ডিস্ক সরে গেছে।'
স্যার আমাকে আরো কী কী বুঝালেন এবং মনের মাধুরী
মিশিয়ে ঝাড়ি দিলেন।
ট্রিটমেন্ট লিখলেন ২১ দিন এবসলিউট বেড রেস্ট। মানে হলো বাথরুমে যাওয়ার জন্যও উঠা যাবে না। বেড রেস্ট না নিলে
'আমি শেষ।' ভালো না হলে যেকোনো মুহুর্তে ডেভেলপ করবে 'কর্ডা ইকুইনা সিন্ড্রোম'। যেটা একটা মেডিকেল ইমার্জেন্সি কন্ডিশন। কোমরের নিচের অংশ প্যারালাইসড
হয়ে যাবে। তখন জরুরী অপারেশন লাগবে। অপারেশনে ঠিকঠাক হবে কিনা বলা যায়না। ঐ অপারেশন আবার নিউরো সার্জারীর ব্যাপার স্যাপার।
স্যারের কথা শুনে আমি সত্যি সত্যি ঘামা শুরু
করলাম। মাথাটা হালকা একটু
চক্কর দিলো। যে স্যারের সামনে ভয়ে জড়োসড় হয়ে দাড়িয়েছিলাম এতোক্ষণ তার সামনেই তার পারমিশন ছাড়া
ধুম করে বসে পড়লাম। এ কী বিপদ!!
স্যারের চেম্বার থেকে বের হয়ে ফোন দিলাম এক
বড় ভাইকে। তিনি সদ্য এম বি বি এস পাশ করেছেন। তাকে বললাম স্যার যা বলেছেন সব। তিনি বললেন - 'তুই এক কাজ কর! একজন নিউরোসার্জনের কাছে চলে যা।'
আমি ঐদিনই চলে গেলাম এক নিউরোসার্জনের কাছে। স্যার কিছুই বললেন
না। শুধু বললেন MRI
করিয়ে আনতে।
MRI খুব অদ্ভুত এক পরীক্ষা। এক যন্ত্রের নিচে আধা
ঘন্টা চুপচাপ চিত হয়ে শুয়ে থাকতে হবে। যন্ত্রটা 'ঘুৎ ঘুৎ' করে প্রচন্ড জোরে শব্দ করতে থাকে সারাক্ষণ। ভয় লাগে, মনে হয় এই
বুঝি যন্ত্রটা নিচে নেমে এসে ভর্তা বানিয়ে ফেলবে। যাই হোক যন্ত্র আমাকে ভর্তা বানালো না। সহিসালামতে MRI
ম্যাশিনের ভেতর থেকে বের হয়ে আসলাম।
MRI ফিল্ম দ্রুতই দিয়ে দেয়। ফিল্ম নিয়ে গেলাম আবার
নিউরোসার্জারির স্যারের কাছে।
মানুষের কেচো খুড়তে সাপ বেরোয়, আমার ক্ষেত্রে বের হলো কুমির। স্যার ফিল্ম দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন 'এইসব রেস্ট ফেস্ট নিয়ে কাজ হবে না। ঘটনা যথেষ্ট প্যাচ খেয়ে গেছে। অপারেশন লাগবে। নাহলে ‘তুমি শেষ’।
আমি মিন মিন করে জিজ্ঞেস করলাম ‘অপারেশনটা কেমন? জটিল?’
স্যার বললেন, ‘উহু। জটিল না। তবে আউটকামটা হচ্ছে আসল কথা। কতোটা ভালো হলো সেটার নির্ভর করবে অপারেশন কতোটা সাকসেস হলো তার উপর।’
- সার্জারি ছাড়া
বিকল্প নেই?
- উহু। রিপোর্ট যা
বলছে তাতে মনে হচ্ছে আর কোনো বিকল্প নেই।
আমি কাটাকুটিকে ভয় পাই। তাও হাত পায়ে হলে একটা কথা
ছিলো। এ তো জমে রীতিমতো জমে মানুষে টানাটানি টাইপ অপারেশন। জেনারেল এনেস্থেশিয়া
দিয়ে অজ্ঞান করা হবে। মুখ দিয়ে পাম্প করা হবে। পিট কেটে ডাক্তার স্পাইনাল কর্ড
নিয়ে ছানাছানি করবেন, অপারেশনের পর ক্যাথাডার ফ্যাথাডার লাগিয়ে জঘন্য অবস্থা হবে! ভাবতেই
আমার জ্বর আসার উপক্রম হলো।
ডাক্তার বদলানো হলো। অন্য ডাক্তার যদি অন্য কিছু
বলেন সেই আশায়। নিউরোসার্জন সিলেটে আছেনই মাত্র কয়েকজন। সবাইকে দেখালাম। সবার
একই কথা- সার্জারি লাগবে।
নিউরোসার্জারি বাদ দিয়ে নিরোমেডিসিন স্পেশালিস্টের
কাছে গেলাম। যদি কাটাকাটি ছাড়া ওষুধে কিছু হয় সেই আশায়। আমার আশায় তিনি পানি ঢাললেন। তিনি সার্জনদের চেয়ে আরো গরম। প্রেসক্রিপশন দেয়ার বদলে ইন্ডিয়ার বিভিন্ন
হাসপাতালের ঠিকানা দিয়ে দিলেন। সেখানে নাকি এসব সার্জারি ভালো হয়।
পরিচিত আরো কিছু অর্থপেডিক সার্জন, ট্রমা সার্জন
দেখানো হলো। সবাই মোটামুটি একই কথা বললেন। এই বয়সে এসব অপারেশন দেশের বাইরে করানোই
ভালো। আর যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ততো ভালো। নার্ভ টার্ভে ইনজুরি হয়ে গেলে সমস্যা।
আমার অবস্থা তখন সঙ্গীন। পায়ে একটা মশা কামড় দিলেও
মনে হয় এই বুঝি 'কর্ডা ইকুইনা সিন্ড্রোম' ডেভলপ করলো! এই বুঝি 'ফুট ড্রপ' হয়ে গেলো!
পাসপোর্টের জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু হলো। যতো তাড়াতাড়ি
সম্ভব পাসপোর্ট হবে ততো ভালো।
(চলবে...)
0 মন্তব্য(গুলি) :
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
পিসি ইউজাররা উপরের(ফেইসবুক কমেন্ট) অথবা নিচের যেকোনো বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। আর মোবাইল ব্যবহারকারীরা যে বক্সটি দেখা যাচ্ছে সেটিতে কমেন্ট করুন।