সম্ভবত কাল শেষ লেকচার ক্লাস। তারপর ব্লক পোস্টিং।
ছাত্র সুবিধার না। তাই বেশিরভাগ লেকচার ক্লাসেই আমি কখনো মনোযোগ দেইনি। লেকচার গ্যালারিতে বসে বসে কলম কামড়ানো, বেগের চেইন নিয়ে গুতাগুতি করা আর একটু পরপর ঘড়ির দিকে তাকানোই ছিলো আমার প্রধান কাজ।
বেসরকারী মেডিকেলের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তা স্বত্ত্বেও একটা কারণে বুকের ছাতি কয়েক হাত ফুলে থাকবে সারাজীবন - বাংলাদেশের লিজেন্ড ধরনের কিছু প্রফেসরের সরাসরি ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট লেভেলে।
অমনোযোগী ছাত্র হলেও তাদের সবার সাথে কিছু অভিজ্ঞতা জমা হয়েছে। পুরোনো হবার আগেই কিছু অভিজ্ঞতা লিখে রাখা যেতে পারে। ১৫/২০ বছর পর টাইমলাইন ঘেটে পড়তে মনে হয় খারাপ লাগবেনা।
কার্ডিওলোজির ফজলুল হক স্যার। কার্ডিওলোজির ক্লাস নিতেন চারজন। অন্যদের ক্লাসগুলো বুঝতাম বাট আই কনফেস, ফজলুল হক স্যারের লেকচার ক্লাসগুলোর বেশিরভাগ টপিকই আমি বুঝতাম না। পিউর ব্রিটিশ ইংলিশে কেউ টানা লেকচার নিলে বুঝার কথাও না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, কিছু না বুঝলেও আমি পুরো এক ঘন্টা ক্লাসে স্যারের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতাম। কীভাবে সম্ভব! একটা মানুষ কীভাবে এত পারফেক্ট হয় ভেবে কুল কিনারা পাইনি। কথা বলার স্টাইল থেকে শুরু করে দাঁড়ানো ভঙ্গি - এই মানুষটার সবকিছু আলাদা।
কিছুদিন আগে ওয়ার্ডে এক সহপাঠিকে স্যার বেশ ঝাড়ি দিয়েছিলেন। স্যারের ঝাড়ি শুনে আমার যেটা মনে হয়েছে সেটা হলো, 'একটা মানুষ এত চমৎকার ভঙ্গীতে ঝাড়ি দেয় কীভাবে!'
পেডিয়াট্রিক মেডিসিনের ফারজানা হামিদ ম্যাডাম। বছরখানেক আগে এমআরসিপি শেষ করে জয়েন করেছেন। ঘটনাক্রমে তিনি ফজলুল হক স্যারের স্ত্রী। আগেই বলেছি, আমি ছাত্র ভালো না। বুঝি কম। কিন্তু ফারজানা হামিদ ম্যাডামের ক্লাসের খুব কম অংশই আমি বুঝিনি, এত অসাধারণ করে পড়ান ম্যাডাম।
আমার দেখা সবচেয়ে অসাধারণ দৃশ্যগুলোর একটি হচ্ছে ম্যাডাম ড্রাইভ করছেন, পাশে ফজলুল হক স্যার, সারের কোলে তাদের ছেলে! বেশ কয়েকবার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে দৃশ্যটা।
প্রফেসর এম এনায়েতউল্লাহ। ছোটখাটো দেহের খুব সাধাসিধে এই মানুষটা বাংলাদেশে প্রেসক্রিপশন লেখার নতুন নিয়ম চালু করেছিলেন। কোনো ওষুধ ২ বেলা হলে 1+0+1. তিনবেলা হলে 1+1+1. একবেলা হলে 0+0+1। সে নিয়ম এখনও চলছে পুরো দেশে। ৫ বছরে এই একজন স্যারের সবগুলো লেকচারই এই নাদান বান্দা হুবুহু তুলেছিলাম।
অর্থপেডিক্সের প্রফেসর এম এ গফফার। প্রচন্ড শৌখিন মানুষ। ডাক্তারি না করে লেখালেখির লাইনে গেলে হুমায়ূন আহমেদ হতেন স্যার।
স্যারের কোর্টের বোতাম সোনালী, ঘড়ির রঙ সোনালী, চশমার ফ্রেম সোনালী, ল্যাপটপ সোনালী, পয়েন্টার সোনালী, ব্যাগের বোতাম সোনালী, কলমও সোনালী। স্যারের এই সোনালী রঙ প্রীতির কারণটা জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে আছে একদিন।
প্রসন্ডরকম ভ্রমনপ্রেমী মানুষ গফফার স্যার। পৃথিবীর প্রায় সব দর্শনীয় যায়গাই সম্ভবত স্যার দেখে ফেলেছেন। স্যারের স্টাইল হচ্ছে লেকচার শুরু করেন এরকম যায়গার বর্ননা দিয়ে। ওখানে চলছিলো অর্থপেডিক্সের সেমিনার... তখনই আমি ওখানে যাই... সাথে ছিলো আমার ওয়াইফ... তো হলো কী...!
একবার ওয়ার্ডে স্যার আমাকে ফ্যান করতে বলেছিলেন। আমি সব সুইচ অফ করলাম কাজ হলোনা। ফ্যানের সুইচ অফ করলাম সবার পরে। স্যার বললেন, 'আরে গাধা! রেগুলেটরের পাশে যে সুইচ ওটাই তো ফ্যানের সুইচ। বাসায় কোনোদিন ফ্যান অফ করোনা, আমি শিউর। এবং এর জন্য তোমার মা তোমাকে রেগুলার গালাগালি করেম, এটাও আমি শিউর।'
ঘটনা আসলেই সত্য। আমি জীবনেও ফ্যান অফ করিনা এবং এর জন্য নিয়মিত আম্মার গালি খাই।
গফফার স্যার ছিলেন সোনালী রংপ্রেমী, অর্থপেডিক্সের আরেক প্রফেসর রুহুল আমিন স্যার ছিলেন সাদা প্রেমী। ধবধবে সাদা দাড়ি, সাথে ধবধবে সাদা পায়জামা, পাঞ্জাবী। পবিত্র একটা চেহারা। বাংলাদেশের প্রথম ২০ জন অর্থপেডিক্স সার্জনের একজন স্যার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন দেশে ট্রমা সার্জনের খুব অভাব তখন বঙ্গবন্ধু সরকার এই বিশজনকে বাইরে থেকে প্রশিক্ষন দিয়ে এনেছিলেন।
কেমন জানি দেখলেই মন ভালো হয়ে যায় টাইপের চেহারা মানুষটার।
... আজ লিখতে ভাল্লাগছেনা আর। বাকিটা কাল হয়তো।
ছাত্র সুবিধার না। তাই বেশিরভাগ লেকচার ক্লাসেই আমি কখনো মনোযোগ দেইনি। লেকচার গ্যালারিতে বসে বসে কলম কামড়ানো, বেগের চেইন নিয়ে গুতাগুতি করা আর একটু পরপর ঘড়ির দিকে তাকানোই ছিলো আমার প্রধান কাজ।
বেসরকারী মেডিকেলের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তা স্বত্ত্বেও একটা কারণে বুকের ছাতি কয়েক হাত ফুলে থাকবে সারাজীবন - বাংলাদেশের লিজেন্ড ধরনের কিছু প্রফেসরের সরাসরি ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট লেভেলে।
অমনোযোগী ছাত্র হলেও তাদের সবার সাথে কিছু অভিজ্ঞতা জমা হয়েছে। পুরোনো হবার আগেই কিছু অভিজ্ঞতা লিখে রাখা যেতে পারে। ১৫/২০ বছর পর টাইমলাইন ঘেটে পড়তে মনে হয় খারাপ লাগবেনা।
কার্ডিওলোজির ফজলুল হক স্যার। কার্ডিওলোজির ক্লাস নিতেন চারজন। অন্যদের ক্লাসগুলো বুঝতাম বাট আই কনফেস, ফজলুল হক স্যারের লেকচার ক্লাসগুলোর বেশিরভাগ টপিকই আমি বুঝতাম না। পিউর ব্রিটিশ ইংলিশে কেউ টানা লেকচার নিলে বুঝার কথাও না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, কিছু না বুঝলেও আমি পুরো এক ঘন্টা ক্লাসে স্যারের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতাম। কীভাবে সম্ভব! একটা মানুষ কীভাবে এত পারফেক্ট হয় ভেবে কুল কিনারা পাইনি। কথা বলার স্টাইল থেকে শুরু করে দাঁড়ানো ভঙ্গি - এই মানুষটার সবকিছু আলাদা।
কিছুদিন আগে ওয়ার্ডে এক সহপাঠিকে স্যার বেশ ঝাড়ি দিয়েছিলেন। স্যারের ঝাড়ি শুনে আমার যেটা মনে হয়েছে সেটা হলো, 'একটা মানুষ এত চমৎকার ভঙ্গীতে ঝাড়ি দেয় কীভাবে!'
পেডিয়াট্রিক মেডিসিনের ফারজানা হামিদ ম্যাডাম। বছরখানেক আগে এমআরসিপি শেষ করে জয়েন করেছেন। ঘটনাক্রমে তিনি ফজলুল হক স্যারের স্ত্রী। আগেই বলেছি, আমি ছাত্র ভালো না। বুঝি কম। কিন্তু ফারজানা হামিদ ম্যাডামের ক্লাসের খুব কম অংশই আমি বুঝিনি, এত অসাধারণ করে পড়ান ম্যাডাম।
আমার দেখা সবচেয়ে অসাধারণ দৃশ্যগুলোর একটি হচ্ছে ম্যাডাম ড্রাইভ করছেন, পাশে ফজলুল হক স্যার, সারের কোলে তাদের ছেলে! বেশ কয়েকবার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে দৃশ্যটা।
প্রফেসর এম এনায়েতউল্লাহ। ছোটখাটো দেহের খুব সাধাসিধে এই মানুষটা বাংলাদেশে প্রেসক্রিপশন লেখার নতুন নিয়ম চালু করেছিলেন। কোনো ওষুধ ২ বেলা হলে 1+0+1. তিনবেলা হলে 1+1+1. একবেলা হলে 0+0+1। সে নিয়ম এখনও চলছে পুরো দেশে। ৫ বছরে এই একজন স্যারের সবগুলো লেকচারই এই নাদান বান্দা হুবুহু তুলেছিলাম।
অর্থপেডিক্সের প্রফেসর এম এ গফফার। প্রচন্ড শৌখিন মানুষ। ডাক্তারি না করে লেখালেখির লাইনে গেলে হুমায়ূন আহমেদ হতেন স্যার।
স্যারের কোর্টের বোতাম সোনালী, ঘড়ির রঙ সোনালী, চশমার ফ্রেম সোনালী, ল্যাপটপ সোনালী, পয়েন্টার সোনালী, ব্যাগের বোতাম সোনালী, কলমও সোনালী। স্যারের এই সোনালী রঙ প্রীতির কারণটা জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে আছে একদিন।
প্রসন্ডরকম ভ্রমনপ্রেমী মানুষ গফফার স্যার। পৃথিবীর প্রায় সব দর্শনীয় যায়গাই সম্ভবত স্যার দেখে ফেলেছেন। স্যারের স্টাইল হচ্ছে লেকচার শুরু করেন এরকম যায়গার বর্ননা দিয়ে। ওখানে চলছিলো অর্থপেডিক্সের সেমিনার... তখনই আমি ওখানে যাই... সাথে ছিলো আমার ওয়াইফ... তো হলো কী...!
একবার ওয়ার্ডে স্যার আমাকে ফ্যান করতে বলেছিলেন। আমি সব সুইচ অফ করলাম কাজ হলোনা। ফ্যানের সুইচ অফ করলাম সবার পরে। স্যার বললেন, 'আরে গাধা! রেগুলেটরের পাশে যে সুইচ ওটাই তো ফ্যানের সুইচ। বাসায় কোনোদিন ফ্যান অফ করোনা, আমি শিউর। এবং এর জন্য তোমার মা তোমাকে রেগুলার গালাগালি করেম, এটাও আমি শিউর।'
ঘটনা আসলেই সত্য। আমি জীবনেও ফ্যান অফ করিনা এবং এর জন্য নিয়মিত আম্মার গালি খাই।
গফফার স্যার ছিলেন সোনালী রংপ্রেমী, অর্থপেডিক্সের আরেক প্রফেসর রুহুল আমিন স্যার ছিলেন সাদা প্রেমী। ধবধবে সাদা দাড়ি, সাথে ধবধবে সাদা পায়জামা, পাঞ্জাবী। পবিত্র একটা চেহারা। বাংলাদেশের প্রথম ২০ জন অর্থপেডিক্স সার্জনের একজন স্যার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন দেশে ট্রমা সার্জনের খুব অভাব তখন বঙ্গবন্ধু সরকার এই বিশজনকে বাইরে থেকে প্রশিক্ষন দিয়ে এনেছিলেন।
কেমন জানি দেখলেই মন ভালো হয়ে যায় টাইপের চেহারা মানুষটার।
... আজ লিখতে ভাল্লাগছেনা আর। বাকিটা কাল হয়তো।
0 মন্তব্য(গুলি) :
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
পিসি ইউজাররা উপরের(ফেইসবুক কমেন্ট) অথবা নিচের যেকোনো বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। আর মোবাইল ব্যবহারকারীরা যে বক্সটি দেখা যাচ্ছে সেটিতে কমেন্ট করুন।