সময়টা খুব সম্ভবত ১৯৯৯ সাল। ক্লাস থ্রি কিংবা ফোরে পড়ি।
একদিন খবর পেলাম গ্রামে 'কারেন্ট' আসবে। প্রথমে বিশ্বাসই হলোনা। কারেন্ট আসবে? বলে কী! কারেন্ট তো কেবল 'সিলেটে' থাকে। আমার কাছে তখন 'সিলেট' আর 'শহর' সমার্থক শব্দ।
স্কুলে বন্ধু মহলে আমার আলাদা একটা মর্যাদা ছিলো। কারণ আমি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার সিলেটে গিয়েছি। ৫ বার। শুধু তাই নয়, এর মধ্যে একবার রাতে থাকার অভিজ্ঞতাও হয়েছে।
আমি প্রতিবার সিলেট থেকে এসে বুক ফুলিয়ে বন্ধুদের কাছে সিলেটের গল্প বলেছি - ঘটনা জানো? সিলেটে ফ্যান আছে। 'চুইস' দিলেই ফ্যান ঘুরে। লাইটও আছে। চুইস দিলে জ্বলে। অনেক 'পাওয়ার'।
বন্ধুরা মুগ্ধ হয়ে আমার কাছ থেকে সিলেটের গল্প শুনতো, 'কারেন্ট'এর গল্প শুনতো। এই কারেন্ট সিলেট থেকে এক লাফে গ্রামে চলে আসবে, আমার মতো তারাও সেটা বিশ্বাস করলোনা।
আমাদের অবিশ্বাসকে মিথ্যা প্রমান করে একদিন সত্যি সত্যি গ্রামে 'কারেন্টের লোকজন' চলে আসলো। তারা ফিতা দিয়ে মাঠে নানারকম মাপামাপি করে চলে গেলো।
তার কিছুদিন পর ঘটলো আরো বিষ্ময়কর ঘটনা। একদিন দেখলাম দুই চাকার একপ্রকার ঠেলাগাড়িতে করে অনেকগুলো 'কারেন্টের খুটি' এলাকায় এসে ঢুকলো। এবং এই ঘটনা ঘটার সাথে সাথে আমাদের পড়াশোনা আক্ষরিক অর্থেই লাটে উঠে গেলো।
এরপর থেকে আমাদের কাজ হলো একটাই - স্কুলের নাম করে বাড়ি থেকে বের হওয়া আর 'কারেন্টের লোকে'র পিছনে ঘুরঘুর করা।
যেখানেই কারেন্টের লোক, সেখানেই আমরা। কারেন্টের লোকজন তখন আমাদের কাছে অতিমানবের চেয়েও বেশিকিছু।
আমরা চোখেমুখে অপার্থিব বিষ্ময় নিয়ে দেখতাম, তারা গভীর সব গর্ত খুড়ছে। গর্ত খুড়া হয়ে গেলে সবাই মিলে ধরে সেখানে একটা খুটি বসিয়ে দিচ্ছে।
মাঝে মাঝে আমাদের মধ্যকার সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ছেলেটির ডাক পড়তো - এই ছেলে প্লাসটা একটু দাও... অথবা স্ক্রুটা একটু ধরো...।
যার ডাক পড়তো আমরা পৃথিবীর সব হিংসা নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম তার দিকে।
একবছর কাটলো এভাবে। একদিন কারেন্টের লোকজনের কাজ শেষ হলো। শুধু আমাদের গ্রাম না, আশপাশের সব গ্রামেও লাইন টানা হলো।
আস্তে আস্তে সব গ্রামে কারেন্ট চলে আসলো। কিন্তু আমাদের গ্রামে আসলো না। কারণ কর্তৃপক্ষের রিকোয়ারমেন্ট ছিলো গ্রামে অন্তত ৩০ টি পরিবারকে বিদ্যুতের গ্রাহক হতে হবে। কিন্তু আমাদের গ্রামে গ্রাহক হতে রাজি হলো ২৫টি পরিবার। অনেকেই অফিসে যোগাযোগ করলো, কিন্তু কারেন্ট আর আসলোনা।
অন্যদিকে পাশের গ্রামের সব সহপাঠির বাসায় তখন কারেন্ট চলে এসেছে।
আমি প্রতিদিন স্কুলে যাই, সহপাঠিদের সবাই আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে কারেন্টের গল্প করে - জানিস? এখন আর ব্যাটারি চার্জ দিতে হয়না... আমাদের বাড়ির সব লাইট একশো পাওয়ারের... অনেক পাওয়ার... কারেন্টের লাইটে অনেক পোকা আসে...'
আমি শুকনো মুখে তাদের কথা শুনতাম আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম।
আমি তখন কারেন্টের আসা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি।
হারিকেনের আলোতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় পড়াশোনা শেষ করে বাবার পাশে ঘুমাতে যাই। বাবা হাতপাখা দিয়ে বাতাস করেন, আমি দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ি।
সেদিনও এভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পরেই ডাক দিলেন মা - উঠ... দেখ কী হয়েছে।
আমি খুব অনিচ্ছা নিয়ে আস্তে আস্তে চোখ মেললাম। দেখলাম, মাথার উপর ভনভন করে ঘুরছে কিছু একটা। দেয়ালে লাগানো বোতল সাইজের বাল্বগুলো থেকে আসছে তীব্র আলো।
সে রাতে অনেকক্ষণ ঘুম হলো না। ফ্যানের নিচে শুয়ে শুয়ে ১০০ পাওয়ারের বাল্বের দিকে তাকিয়েই কেটে গিয়েছিলো কয়েক ঘন্টা।
রবীন্দ্রনাথ নামের এক বুড়ো সম্ভবত সে রাতের এক মুগ্ধ বালকের কথা ভেবেই অনেক আগে লিখে গিয়েছিলেন, 'নাচে আলো নাচে, ও ভাই, আমার প্রাণের কাছে -- বাজে আলো বাজে, ও ভাই, হৃদয়বীণার মাঝে -- জাগে আকাশ, ছোটে বাতাস, হাসে সকল ধরা -- আলো আমার আলো ওগো, আলো ভুবন-ভরা...'
একদিন খবর পেলাম গ্রামে 'কারেন্ট' আসবে। প্রথমে বিশ্বাসই হলোনা। কারেন্ট আসবে? বলে কী! কারেন্ট তো কেবল 'সিলেটে' থাকে। আমার কাছে তখন 'সিলেট' আর 'শহর' সমার্থক শব্দ।
স্কুলে বন্ধু মহলে আমার আলাদা একটা মর্যাদা ছিলো। কারণ আমি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার সিলেটে গিয়েছি। ৫ বার। শুধু তাই নয়, এর মধ্যে একবার রাতে থাকার অভিজ্ঞতাও হয়েছে।
আমি প্রতিবার সিলেট থেকে এসে বুক ফুলিয়ে বন্ধুদের কাছে সিলেটের গল্প বলেছি - ঘটনা জানো? সিলেটে ফ্যান আছে। 'চুইস' দিলেই ফ্যান ঘুরে। লাইটও আছে। চুইস দিলে জ্বলে। অনেক 'পাওয়ার'।
বন্ধুরা মুগ্ধ হয়ে আমার কাছ থেকে সিলেটের গল্প শুনতো, 'কারেন্ট'এর গল্প শুনতো। এই কারেন্ট সিলেট থেকে এক লাফে গ্রামে চলে আসবে, আমার মতো তারাও সেটা বিশ্বাস করলোনা।
আমাদের অবিশ্বাসকে মিথ্যা প্রমান করে একদিন সত্যি সত্যি গ্রামে 'কারেন্টের লোকজন' চলে আসলো। তারা ফিতা দিয়ে মাঠে নানারকম মাপামাপি করে চলে গেলো।
তার কিছুদিন পর ঘটলো আরো বিষ্ময়কর ঘটনা। একদিন দেখলাম দুই চাকার একপ্রকার ঠেলাগাড়িতে করে অনেকগুলো 'কারেন্টের খুটি' এলাকায় এসে ঢুকলো। এবং এই ঘটনা ঘটার সাথে সাথে আমাদের পড়াশোনা আক্ষরিক অর্থেই লাটে উঠে গেলো।
এরপর থেকে আমাদের কাজ হলো একটাই - স্কুলের নাম করে বাড়ি থেকে বের হওয়া আর 'কারেন্টের লোকে'র পিছনে ঘুরঘুর করা।
যেখানেই কারেন্টের লোক, সেখানেই আমরা। কারেন্টের লোকজন তখন আমাদের কাছে অতিমানবের চেয়েও বেশিকিছু।
আমরা চোখেমুখে অপার্থিব বিষ্ময় নিয়ে দেখতাম, তারা গভীর সব গর্ত খুড়ছে। গর্ত খুড়া হয়ে গেলে সবাই মিলে ধরে সেখানে একটা খুটি বসিয়ে দিচ্ছে।
মাঝে মাঝে আমাদের মধ্যকার সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ছেলেটির ডাক পড়তো - এই ছেলে প্লাসটা একটু দাও... অথবা স্ক্রুটা একটু ধরো...।
যার ডাক পড়তো আমরা পৃথিবীর সব হিংসা নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম তার দিকে।
একবছর কাটলো এভাবে। একদিন কারেন্টের লোকজনের কাজ শেষ হলো। শুধু আমাদের গ্রাম না, আশপাশের সব গ্রামেও লাইন টানা হলো।
আস্তে আস্তে সব গ্রামে কারেন্ট চলে আসলো। কিন্তু আমাদের গ্রামে আসলো না। কারণ কর্তৃপক্ষের রিকোয়ারমেন্ট ছিলো গ্রামে অন্তত ৩০ টি পরিবারকে বিদ্যুতের গ্রাহক হতে হবে। কিন্তু আমাদের গ্রামে গ্রাহক হতে রাজি হলো ২৫টি পরিবার। অনেকেই অফিসে যোগাযোগ করলো, কিন্তু কারেন্ট আর আসলোনা।
অন্যদিকে পাশের গ্রামের সব সহপাঠির বাসায় তখন কারেন্ট চলে এসেছে।
আমি প্রতিদিন স্কুলে যাই, সহপাঠিদের সবাই আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে কারেন্টের গল্প করে - জানিস? এখন আর ব্যাটারি চার্জ দিতে হয়না... আমাদের বাড়ির সব লাইট একশো পাওয়ারের... অনেক পাওয়ার... কারেন্টের লাইটে অনেক পোকা আসে...'
আমি শুকনো মুখে তাদের কথা শুনতাম আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম।
আমি তখন কারেন্টের আসা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি।
হারিকেনের আলোতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় পড়াশোনা শেষ করে বাবার পাশে ঘুমাতে যাই। বাবা হাতপাখা দিয়ে বাতাস করেন, আমি দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ি।
সেদিনও এভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পরেই ডাক দিলেন মা - উঠ... দেখ কী হয়েছে।
আমি খুব অনিচ্ছা নিয়ে আস্তে আস্তে চোখ মেললাম। দেখলাম, মাথার উপর ভনভন করে ঘুরছে কিছু একটা। দেয়ালে লাগানো বোতল সাইজের বাল্বগুলো থেকে আসছে তীব্র আলো।
সে রাতে অনেকক্ষণ ঘুম হলো না। ফ্যানের নিচে শুয়ে শুয়ে ১০০ পাওয়ারের বাল্বের দিকে তাকিয়েই কেটে গিয়েছিলো কয়েক ঘন্টা।
রবীন্দ্রনাথ নামের এক বুড়ো সম্ভবত সে রাতের এক মুগ্ধ বালকের কথা ভেবেই অনেক আগে লিখে গিয়েছিলেন, 'নাচে আলো নাচে, ও ভাই, আমার প্রাণের কাছে -- বাজে আলো বাজে, ও ভাই, হৃদয়বীণার মাঝে -- জাগে আকাশ, ছোটে বাতাস, হাসে সকল ধরা -- আলো আমার আলো ওগো, আলো ভুবন-ভরা...'
0 মন্তব্য(গুলি) :
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
পিসি ইউজাররা উপরের(ফেইসবুক কমেন্ট) অথবা নিচের যেকোনো বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। আর মোবাইল ব্যবহারকারীরা যে বক্সটি দেখা যাচ্ছে সেটিতে কমেন্ট করুন।