আমরা তখনও খড়ের ঘরে থাকি। পাকা ঘরবাড়ি বানানোটা খুব জরুরী। আম্মা প্রতিদিন আব্বার কানে বকবক করেন। আব্বা সেদিকে পাত্তা দেন না। তার কাছে 'বাড়ি'র চেয়ে 'গাড়ি' কেনা জরুরী মনে হলো।
একদিন সন্ধ্যায় চা খেতে খেতেই সিদ্ধান্ত ফাইনাল হয়ে গেলো, আমরা গাড়ি কিনবো।
আব্বা বললেন 'একটা গাড়ি না থাকলে কী আছে জীবনে?'
আমরা তার কথা শুনে মাথা নাড়ালাম। বেশি মাথা নাড়ালেন মেজো চাচা। তার উৎসাহ সবচেয়ে বেশি। তিনি হাতে কিল মেরে বললেন, 'চমৎকার সিদ্ধান্ত। গাড়ি ছাড়া জীবনে কিছুই নাই।'
নতুন গাড়ি কেনার টাকা নেই, সেকেন্ড হ্যান্ড কিনতে হবে। সিলেট শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরের এক গ্রামে ফিরতে আব্বার প্রতিদিন এমনিতেই সন্ধ্যা হয়ে যেতো। গাড়ি প্রজেক্ট চালু হওয়ার পর দেরী আরো বাড়লো।
আব্বা কোর্ট শেষে গাড়ির খোঁজখবর নিতে বের হোন, সাথে থাকেন মেজো চাচা। চাচা তার ডান হাত, বাম হাত সবকিছু। বাড়ি ফিরতে হয়ে যায় রাত ১১টা/১২টা।
১০/১২ দিন চললো তুমুল খোঁজাখুঁজি। অবশেষে একটা গাড়ি পছন্দ হলো, দামে পোষালো, কেনাও হলো। ড্রাইভারও রাখা হলো একজন।
কিন্তু ক্ষুদ্র একটা সমস্যা হয়ে গেলো।
গাড়ি যে বাড়িতে আসবে রাস্তাটা কই? এই রাস্তা দিয়ে সপ্তাহে রিক্সাই চলে ৪/৫ টা। গাড়ি আসবে কীভাবে?
আব্বার ব্যক্তিগত উদ্যোগে ২ কিলোমিটার রাস্তা কেটেকুটে গাড়ি চলার উপযুক্ত করা হলো। একদিন বিকালে সেই রাস্তা দিয়ে বাড়িতে গাড়িও চলে আসলো।
সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। বাড়ি নেই, রাস্তা নেই, কিন্তু গাড়ি আছে।
গাড়ি দেখার জন্য কয়েক'শ মানুষ বাড়িতে চলে আসলো। আশপাশের ছোটছোট ছেলেমেয়েদেরকে আমি গাড়ির কাছেও ঘেষতে দিলাম না। পৃথিবীর সব অহংকার নিয়ে আমি গাড়ি পাহারা দিতে শুরু করলাম। বন্ধুমহলে আমার পার্ট সার্ট কয়েকগুন বেড়ে গেলো।
শুধু আমার না, পরিবারের সবার পার্টসার্টই বেড়ে গেলো। ঠাশঠুশ করে দরজা বন্ধ করি। ঘরের আয়নায় মুখ দেখিনা, গাড়ির আয়নায় দেখি। আমরা প্রায় প্রতিদিন বিকালেই গাড়িতে করে ঘুরতে চলে যাই। গাড়িতে বসার যায়গা আছে মোটে পাঁচজনের। আমরা বসতাম দশজন। এতে কষ্টের বদলে আনন্দই হতো বেশি।
এখানে যাবো, ওখানে যাবো... গাড়ি নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা বাড়তেই থাকলো।
তখনও জানতাম না,আমাদের চেয়েও ভয়ংকর পরিকল্পনা ঘুরছিলো আব্বার মাথায়। একদিন সন্ধ্যায় আব্বা সবাইকে ডাকলেন। আমরা বসলাম।
আব্বা বললেন, 'গাড়ি তো কিনলাম। এবার জনগনের জন্য কিছু করা উচিত। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চ্যায়ারম্যান পদে দাঁড়াবো। সবার সিদ্ধান্ত কী?'
মেজো চাচা হাতে কিল মেরে বললেন, 'চমৎকার সিদ্ধান্ত। কাল থেকেই প্রচারণা শুরু। গাড়ি তো আছেই। যেখানে ইচ্ছা সেখানে চলে যাবো। জনগন ভোট না দিয়ে যাবে কই?'
আব্বা চ্যায়ারম্যান পদে দাঁড়ালেন। পোস্টার ছাপানো হলো, মাইকের ব্যাবস্থা করা হলো, প্রচারণা শুরু হলো।
সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আমিও মাইকে আব্বার পক্ষে স্লোগান দিতাম, 'আমার ভাই, তোমার ভাই অমুক ভাই অমুক ভাই...'
জমে উঠলো নির্বাচন। আব্বার জনসমর্থন তখন তুঙ্গে। সিলেটের ডাক পত্রিকায় কয়েকটা রিপোর্টও আসলো - 'মূল লড়াই হবে মোমবাতি আর চাকা মার্কার'। মোমবাতি ছিলো আব্বার প্রতীক।
সেদিন ছিলো নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিন। আব্বা শেষ জনসভা করলেন।
অন্যদিকে ঘটে গেলো একটি মজার ঘটনা। কুলা মার্কার প্রার্থী তার শেষ জনসভায় ঘোষণা দিয়ে দিলেন, 'মোমবাতি মার্কা তাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেছেন। তাদের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, তাদের ভোট যেনো দেয়া হয় কুলা মার্কায়। তিনি আমাদের সাথে আছেন।'
সংবাদের চেয়ে গুজব ছড়ায় দ্রুত। এই গুজবও ছড়িয়ে গেলো। আমাদের পক্ষ থেকে ট্যাকেল দেয়ার চেষ্টা করা হলো। কিন্তু তখন প্রচারণা থেমে যাওয়ায় খুব একটা কাজ দিলোনা।
আব্বা অল্প ব্যাবধানে হেরে গেলেন।
তার কিছুদিন পর মেজো চাচা গাড়ি এক্সিডেন্ট করলেন। তারপর গাড়ি বিক্রি করে দেয়া হলো।
একদিন সন্ধ্যায় চা খেতে খেতেই সিদ্ধান্ত ফাইনাল হয়ে গেলো, আমরা গাড়ি কিনবো।
আব্বা বললেন 'একটা গাড়ি না থাকলে কী আছে জীবনে?'
আমরা তার কথা শুনে মাথা নাড়ালাম। বেশি মাথা নাড়ালেন মেজো চাচা। তার উৎসাহ সবচেয়ে বেশি। তিনি হাতে কিল মেরে বললেন, 'চমৎকার সিদ্ধান্ত। গাড়ি ছাড়া জীবনে কিছুই নাই।'
নতুন গাড়ি কেনার টাকা নেই, সেকেন্ড হ্যান্ড কিনতে হবে। সিলেট শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরের এক গ্রামে ফিরতে আব্বার প্রতিদিন এমনিতেই সন্ধ্যা হয়ে যেতো। গাড়ি প্রজেক্ট চালু হওয়ার পর দেরী আরো বাড়লো।
আব্বা কোর্ট শেষে গাড়ির খোঁজখবর নিতে বের হোন, সাথে থাকেন মেজো চাচা। চাচা তার ডান হাত, বাম হাত সবকিছু। বাড়ি ফিরতে হয়ে যায় রাত ১১টা/১২টা।
১০/১২ দিন চললো তুমুল খোঁজাখুঁজি। অবশেষে একটা গাড়ি পছন্দ হলো, দামে পোষালো, কেনাও হলো। ড্রাইভারও রাখা হলো একজন।
কিন্তু ক্ষুদ্র একটা সমস্যা হয়ে গেলো।
গাড়ি যে বাড়িতে আসবে রাস্তাটা কই? এই রাস্তা দিয়ে সপ্তাহে রিক্সাই চলে ৪/৫ টা। গাড়ি আসবে কীভাবে?
আব্বার ব্যক্তিগত উদ্যোগে ২ কিলোমিটার রাস্তা কেটেকুটে গাড়ি চলার উপযুক্ত করা হলো। একদিন বিকালে সেই রাস্তা দিয়ে বাড়িতে গাড়িও চলে আসলো।
সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। বাড়ি নেই, রাস্তা নেই, কিন্তু গাড়ি আছে।
গাড়ি দেখার জন্য কয়েক'শ মানুষ বাড়িতে চলে আসলো। আশপাশের ছোটছোট ছেলেমেয়েদেরকে আমি গাড়ির কাছেও ঘেষতে দিলাম না। পৃথিবীর সব অহংকার নিয়ে আমি গাড়ি পাহারা দিতে শুরু করলাম। বন্ধুমহলে আমার পার্ট সার্ট কয়েকগুন বেড়ে গেলো।
শুধু আমার না, পরিবারের সবার পার্টসার্টই বেড়ে গেলো। ঠাশঠুশ করে দরজা বন্ধ করি। ঘরের আয়নায় মুখ দেখিনা, গাড়ির আয়নায় দেখি। আমরা প্রায় প্রতিদিন বিকালেই গাড়িতে করে ঘুরতে চলে যাই। গাড়িতে বসার যায়গা আছে মোটে পাঁচজনের। আমরা বসতাম দশজন। এতে কষ্টের বদলে আনন্দই হতো বেশি।
এখানে যাবো, ওখানে যাবো... গাড়ি নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা বাড়তেই থাকলো।
তখনও জানতাম না,আমাদের চেয়েও ভয়ংকর পরিকল্পনা ঘুরছিলো আব্বার মাথায়। একদিন সন্ধ্যায় আব্বা সবাইকে ডাকলেন। আমরা বসলাম।
আব্বা বললেন, 'গাড়ি তো কিনলাম। এবার জনগনের জন্য কিছু করা উচিত। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চ্যায়ারম্যান পদে দাঁড়াবো। সবার সিদ্ধান্ত কী?'
মেজো চাচা হাতে কিল মেরে বললেন, 'চমৎকার সিদ্ধান্ত। কাল থেকেই প্রচারণা শুরু। গাড়ি তো আছেই। যেখানে ইচ্ছা সেখানে চলে যাবো। জনগন ভোট না দিয়ে যাবে কই?'
আব্বা চ্যায়ারম্যান পদে দাঁড়ালেন। পোস্টার ছাপানো হলো, মাইকের ব্যাবস্থা করা হলো, প্রচারণা শুরু হলো।
সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আমিও মাইকে আব্বার পক্ষে স্লোগান দিতাম, 'আমার ভাই, তোমার ভাই অমুক ভাই অমুক ভাই...'
জমে উঠলো নির্বাচন। আব্বার জনসমর্থন তখন তুঙ্গে। সিলেটের ডাক পত্রিকায় কয়েকটা রিপোর্টও আসলো - 'মূল লড়াই হবে মোমবাতি আর চাকা মার্কার'। মোমবাতি ছিলো আব্বার প্রতীক।
সেদিন ছিলো নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিন। আব্বা শেষ জনসভা করলেন।
অন্যদিকে ঘটে গেলো একটি মজার ঘটনা। কুলা মার্কার প্রার্থী তার শেষ জনসভায় ঘোষণা দিয়ে দিলেন, 'মোমবাতি মার্কা তাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেছেন। তাদের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, তাদের ভোট যেনো দেয়া হয় কুলা মার্কায়। তিনি আমাদের সাথে আছেন।'
সংবাদের চেয়ে গুজব ছড়ায় দ্রুত। এই গুজবও ছড়িয়ে গেলো। আমাদের পক্ষ থেকে ট্যাকেল দেয়ার চেষ্টা করা হলো। কিন্তু তখন প্রচারণা থেমে যাওয়ায় খুব একটা কাজ দিলোনা।
আব্বা অল্প ব্যাবধানে হেরে গেলেন।
তার কিছুদিন পর মেজো চাচা গাড়ি এক্সিডেন্ট করলেন। তারপর গাড়ি বিক্রি করে দেয়া হলো।
0 মন্তব্য(গুলি) :
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
পিসি ইউজাররা উপরের(ফেইসবুক কমেন্ট) অথবা নিচের যেকোনো বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। আর মোবাইল ব্যবহারকারীরা যে বক্সটি দেখা যাচ্ছে সেটিতে কমেন্ট করুন।