ক্লাস এইট পর্যন্ত খড়ের ঘরেই থাকতাম। আমাদের বাড়িটি ছিলো বিশাল। চারটা ঘর। আমি থাকতাম উত্তরের ঘরটাতে। সাথে বাবা, মা এবং বোন।
প্রতি শীতে ঘর ভেঙ্গে আবার ঘর বানানো হতো।
ঘর বানানো মানে হচ্ছে বিশাল বড় উৎসব। এই উৎসবের জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকতাম সারাবছর।
কয়েক মাইল দূর থেকে লম্বা লম্বা খড় এনে স্তুপ করে রাখা হতো।
খড় আনা শেষ হলে আনা হতো 'ইকড়'। ইকড় হচ্ছে গুল্ম ধরণের উদ্ভিদ। এটাও আনা হতো অনেক দূর থেকে।
সবশেষে আনা হতো বাঁশ।
সব উপকরণ আনার পর শুরু হতো ঘর বানানোর কাজ। তবে তার আগেও আনুষ্ঠানিকতা ছিলো। মিলাদের ব্যাবস্থা করা হতো ঐদিন সকালে। সিলেটি ভাষায় আমরা এটাকে বলি 'শিন্নি'। শিন্নি খাওয়া শেষ হতো, মাওলানারা দোয়া করতেন, 'হে আল্লাহ, এই ঘর শক্ত করে দাও, এই ঘরে রহমত আর বরকত বর্ষণ করো।'
দোয়ার পর শুরু হতো ঘরের কাজ। আগের বছরের সব খড় ঘরের চালা থেকে খুলে ফেলা হতো প্রথমে। খোলা শেষ হলে শুরু হতো নতুন করে ঘরের চালা বানানো।
সে এক অসাধারণ প্রক্রিয়া। উঠানে থাকতো ৫/৬ জন, ঘরের চালে থাকতো আরো ৫/৬ জন। উঠানে থাকা মানুষরা ছোট ছোট খড়ের আঁটি ছুড়ে দিতো চালার মানুষের কাছে। চালার মানুষ সেই আটিগুলো অসম্ভব দক্ষতায় ধরে ফেলতেন। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর মুগ্ধ হতাম। মনে মনে বলতাম, বড় হয়ে আমিও নিশ্চয়ই ধরতে পারবো।
পুরো ঘর বানাতে লেগে যেতো ৩/৪ দিন। সেই তিন চারদিন আমরা ঐ ঘরেই থাকতাম। ঘরে চাল নেই, বেড়া নেই, তাও থাকতাম। হা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে যেতাম।
দাদী খুব দোয়া করতেন, এমন রাতে যেনো বৃষ্টি না আসে। আসলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
একবার খুব বৃষ্টি হলো এবং আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেলো। ঘরের চালে কিছু না থাকায় বৃষ্টির পানি এসে পড়লো ভিটাতে। সেবার অনেক ঝামেলা হয়েছিলো।
ঘর বানানো শেষ হতো একটা সময়। সেই ঘরে আমরা নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে যেতাম।
শীতের সময়টা কেটে যেতো ভালোই। সমস্যা দেখা দিতো হতো একটু বৃষ্টি হলেই। ৩/৪ দিন ধরে যত্ন করে বানানো ঘরের চালায় দেখা যেতো অনেকগুলো ফুটা রয়ে গেছে এবং সেই ফুটা দিয়ে বিছানায় অবিরত বৃষ্টির পানি আসছে। পানি সামলানোর দায় পড়তো আম্মার ঘাড়ে। তিনি রান্নাঘর থেকে হাড়ি পাতিল নিয়ে এসে চালার ফুটার নিচে রাখতেন। বৃষ্টি পড়তো পাতিলে, টুং টাং শব্দ হতো। মধুর সে শব্দ। আমরা হাড়ি পাতিলের মধ্যেই গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়তাম।
সবচেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হতো কালবৈশাখীর সময়। একটু বাতাস দিলেই বারান্দায় বেরিয়ে আসতে হবে এবং আজান দিতে হবে এটাই ছিলো নিয়ম।
আমার শৈশবের সবচেয়ে আতংকের অভিজ্ঞতা হচ্ছে সেই রাতগুলো।
উঠানে সারী সারী সুপারি গাছ ছিলো। ঝড় আসলে সুপারী গাছগুলোর মাথা বাঁকা হয়ে মাটিতে নেমে আসতো। বিজলি চমকাতো, বিজলীর আলোয় আমরা দেখতাম সুপারি গাছ বাকা হয়ে নেমে আসছে। গাছে যতো নিচে নেমে আসছে, ঝড় তত বেশি, তত জোরে আজান দিতে হবে।
আমি বেশি ভয় পেতাম, আজানও দিতাম সবচেয়ে বেশি। ঝড় হতো বৈশাখের প্রায় প্রতিটি রাতেই। কিছুক্ষণ আজান দেয়ার পর গলা শুকিয়ে যেতো। কিছুক্ষণ থেমে আবার শুরু করতাম।
ঝড় থামতো, সকাল আসতো। সকালের আলোয় দেখা যেতো আমাদের ঘরগুলো আর ঘর নেই, কংকাল হয়ে আছে। কোথাও খড় নেই, কোথাও বেড়া নেই। সারাদিন ঠিক করা হতো সেগুলো। পরের রাতে ঝড় এসে আবার কংকাল বানিয়ে দিতো সব।
কালবৈশাখীর আক্রমনে আমাদের প্রতিবারই মন খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আমাদের মন খারাপ হতোনা। ঘর ভেঙ্গেছে - এটাও একধরণের উৎসব।
আব্বা ঘর মেরামতকারীদের খবর দিতেন। আমাদের অনেকগুলো ছাগল ছিলো। সুখের অথবা দুঃখের যেকোনো ঘটনা ঘটলেই চাচাদেরকে আব্বা নির্দেশ দিতেন - ছাগল জবাই করে ফেল।
মানুষ এসে ঘর ঠিক করতো আর উঠানের এক কোনে আব্বার নির্দেশে চলতো ছাগল রান্না করা আর খাওয়া দাওয়া।
ঘর ঠিক হলে রাতে ঘুমাতে যেতাম। আম্মা এসে কিছুক্ষণ আব্বাকে গালাগালি করতেন - তোমার সংসারে এসে আমার এই অবস্থা, ঘুমাতেও পারিনা শান্তিমতো। এমন ঘর বানাও, যেনো খোলা আকাশ। কবে যে আমার একটু শান্তি হবে!
আম্মার কথায় আব্বা পাত্তা দিতেন না। তিনি হেলান দিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর বই পড়তেন আর আবার ঝড়ের অপেক্ষা করতেন। সাথে আমিও।
শৈশবকে মিস করি কিনা জানিনা। মনে হয় করিনা।
তবে মাঝে মাঝে মন খারাপ করে দেয় সেই দিনগুলো, রাতগুলোও। মনে হয় সেইসব ঝড়ের রাতে ফেরত গিয়ে আব্বাকে জড়িয়ে ধরে আজান দিতে পারলে মনে হয় খারাপ হতোনা।
প্রতি শীতে ঘর ভেঙ্গে আবার ঘর বানানো হতো।
ঘর বানানো মানে হচ্ছে বিশাল বড় উৎসব। এই উৎসবের জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকতাম সারাবছর।
কয়েক মাইল দূর থেকে লম্বা লম্বা খড় এনে স্তুপ করে রাখা হতো।
খড় আনা শেষ হলে আনা হতো 'ইকড়'। ইকড় হচ্ছে গুল্ম ধরণের উদ্ভিদ। এটাও আনা হতো অনেক দূর থেকে।
সবশেষে আনা হতো বাঁশ।
সব উপকরণ আনার পর শুরু হতো ঘর বানানোর কাজ। তবে তার আগেও আনুষ্ঠানিকতা ছিলো। মিলাদের ব্যাবস্থা করা হতো ঐদিন সকালে। সিলেটি ভাষায় আমরা এটাকে বলি 'শিন্নি'। শিন্নি খাওয়া শেষ হতো, মাওলানারা দোয়া করতেন, 'হে আল্লাহ, এই ঘর শক্ত করে দাও, এই ঘরে রহমত আর বরকত বর্ষণ করো।'
দোয়ার পর শুরু হতো ঘরের কাজ। আগের বছরের সব খড় ঘরের চালা থেকে খুলে ফেলা হতো প্রথমে। খোলা শেষ হলে শুরু হতো নতুন করে ঘরের চালা বানানো।
সে এক অসাধারণ প্রক্রিয়া। উঠানে থাকতো ৫/৬ জন, ঘরের চালে থাকতো আরো ৫/৬ জন। উঠানে থাকা মানুষরা ছোট ছোট খড়ের আঁটি ছুড়ে দিতো চালার মানুষের কাছে। চালার মানুষ সেই আটিগুলো অসম্ভব দক্ষতায় ধরে ফেলতেন। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর মুগ্ধ হতাম। মনে মনে বলতাম, বড় হয়ে আমিও নিশ্চয়ই ধরতে পারবো।
পুরো ঘর বানাতে লেগে যেতো ৩/৪ দিন। সেই তিন চারদিন আমরা ঐ ঘরেই থাকতাম। ঘরে চাল নেই, বেড়া নেই, তাও থাকতাম। হা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে যেতাম।
দাদী খুব দোয়া করতেন, এমন রাতে যেনো বৃষ্টি না আসে। আসলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
একবার খুব বৃষ্টি হলো এবং আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেলো। ঘরের চালে কিছু না থাকায় বৃষ্টির পানি এসে পড়লো ভিটাতে। সেবার অনেক ঝামেলা হয়েছিলো।
ঘর বানানো শেষ হতো একটা সময়। সেই ঘরে আমরা নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে যেতাম।
শীতের সময়টা কেটে যেতো ভালোই। সমস্যা দেখা দিতো হতো একটু বৃষ্টি হলেই। ৩/৪ দিন ধরে যত্ন করে বানানো ঘরের চালায় দেখা যেতো অনেকগুলো ফুটা রয়ে গেছে এবং সেই ফুটা দিয়ে বিছানায় অবিরত বৃষ্টির পানি আসছে। পানি সামলানোর দায় পড়তো আম্মার ঘাড়ে। তিনি রান্নাঘর থেকে হাড়ি পাতিল নিয়ে এসে চালার ফুটার নিচে রাখতেন। বৃষ্টি পড়তো পাতিলে, টুং টাং শব্দ হতো। মধুর সে শব্দ। আমরা হাড়ি পাতিলের মধ্যেই গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়তাম।
সবচেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হতো কালবৈশাখীর সময়। একটু বাতাস দিলেই বারান্দায় বেরিয়ে আসতে হবে এবং আজান দিতে হবে এটাই ছিলো নিয়ম।
আমার শৈশবের সবচেয়ে আতংকের অভিজ্ঞতা হচ্ছে সেই রাতগুলো।
উঠানে সারী সারী সুপারি গাছ ছিলো। ঝড় আসলে সুপারী গাছগুলোর মাথা বাঁকা হয়ে মাটিতে নেমে আসতো। বিজলি চমকাতো, বিজলীর আলোয় আমরা দেখতাম সুপারি গাছ বাকা হয়ে নেমে আসছে। গাছে যতো নিচে নেমে আসছে, ঝড় তত বেশি, তত জোরে আজান দিতে হবে।
আমি বেশি ভয় পেতাম, আজানও দিতাম সবচেয়ে বেশি। ঝড় হতো বৈশাখের প্রায় প্রতিটি রাতেই। কিছুক্ষণ আজান দেয়ার পর গলা শুকিয়ে যেতো। কিছুক্ষণ থেমে আবার শুরু করতাম।
ঝড় থামতো, সকাল আসতো। সকালের আলোয় দেখা যেতো আমাদের ঘরগুলো আর ঘর নেই, কংকাল হয়ে আছে। কোথাও খড় নেই, কোথাও বেড়া নেই। সারাদিন ঠিক করা হতো সেগুলো। পরের রাতে ঝড় এসে আবার কংকাল বানিয়ে দিতো সব।
কালবৈশাখীর আক্রমনে আমাদের প্রতিবারই মন খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আমাদের মন খারাপ হতোনা। ঘর ভেঙ্গেছে - এটাও একধরণের উৎসব।
আব্বা ঘর মেরামতকারীদের খবর দিতেন। আমাদের অনেকগুলো ছাগল ছিলো। সুখের অথবা দুঃখের যেকোনো ঘটনা ঘটলেই চাচাদেরকে আব্বা নির্দেশ দিতেন - ছাগল জবাই করে ফেল।
মানুষ এসে ঘর ঠিক করতো আর উঠানের এক কোনে আব্বার নির্দেশে চলতো ছাগল রান্না করা আর খাওয়া দাওয়া।
ঘর ঠিক হলে রাতে ঘুমাতে যেতাম। আম্মা এসে কিছুক্ষণ আব্বাকে গালাগালি করতেন - তোমার সংসারে এসে আমার এই অবস্থা, ঘুমাতেও পারিনা শান্তিমতো। এমন ঘর বানাও, যেনো খোলা আকাশ। কবে যে আমার একটু শান্তি হবে!
আম্মার কথায় আব্বা পাত্তা দিতেন না। তিনি হেলান দিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর বই পড়তেন আর আবার ঝড়ের অপেক্ষা করতেন। সাথে আমিও।
শৈশবকে মিস করি কিনা জানিনা। মনে হয় করিনা।
তবে মাঝে মাঝে মন খারাপ করে দেয় সেই দিনগুলো, রাতগুলোও। মনে হয় সেইসব ঝড়ের রাতে ফেরত গিয়ে আব্বাকে জড়িয়ে ধরে আজান দিতে পারলে মনে হয় খারাপ হতোনা।
0 মন্তব্য(গুলি) :
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
পিসি ইউজাররা উপরের(ফেইসবুক কমেন্ট) অথবা নিচের যেকোনো বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। আর মোবাইল ব্যবহারকারীরা যে বক্সটি দেখা যাচ্ছে সেটিতে কমেন্ট করুন।