১।
ছোটবেলায় বৃষ্টি হলে খড়ের চাল ফুটা হয়ে যেতো। সেই ফুটা দিয়ে বৃষ্টি আসতো। মা বৃষ্টি থেকে বিছানা বাঁচাতে রান্নাঘর থেকে হাড়ি পাতিল নিয়ে আসতেন। চালের ফুটার ঠিক নিচেই রাখা হতো পাতিল। সেগুলোর ফাঁকে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে যেতাম। পাতিলে টুং-টাং করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তো। আমাদের ঘুম গভীর হতো।
২।
তখন রোজা পড়তো শীতকালে। ধান কেটে নিয়ে আসার পর মাড়াই করা হতো। গরুগুলা ধানের উপর ঘুরতেই থাকতো ঘুরতেই থাকতো। গরুও ক্লান্ত হতো, যারা মাড়াই করছেন তাঁরাও। ইফতারের সময় বসে থাকতো গরুগুলো। বাকিরা ইফতার শেষ আবার ধানের উপর ঘুরা শুরু করতো।
উঠানের কোনায় বসে দাদা কাশতেন, হুক্কা টানতেন আর গল্প করতেন।
দাদা মারা গেছেন তিন বছর হলো। হার্ট অ্যাটাক হয়েছিলো সকাল ৮ টায়। সেদিন ৯ টায় ছিলো এনাটমি প্রফের রিটেন। পরীক্ষা ভালো হয়েছিলো খুব। প্রশ্ন হাতে পেয়ে হেসে দিয়েছিলাম। সব কমন। পরীক্ষা শেষে বের হয়ে কেমন জানি লাগছিলো। দাদা নেই। কী অদ্ভুত! শৈশব পুরোটাই কেটেছে দাদাকে নিয়ে। ১৬ ঘন্টা জেগে থাকলে ১২ ঘন্টাই থাকতাম তাঁর সাথে।
বাড়িতে যাই। মন খারাপ লাগে। বিশেষ করে সন্ধ্যাগুলোতে।
কেউ যে কোথাও নেই—সকলে গিয়েছে মরে—সকলে গিয়েছে চলে—উঠান রয়েছে শুধু একা
শিশুরা কাঁদে না কেউ—রুগিরা হাঁপায় না তো—বুড়োরা কয় না কথা : থুবড়ো ব্যথার কথা যত
এখানে সকাল নাই—এখানে দুপুর নাই—এখানে জনতা নাই—এখানে সমাজ নাই—নাইকো মূর্খ ধাঁধা কিছু
আকাশে চাঁদের আলো—উঠোনে চাঁদের আলো—নীলাভ চাঁদের আলো—এমন চাঁদের আলো আজ
৩।
সবচেয়ে ভালো লাগতো বন্যা আসলে। বিশাল পুকুর ছিলো দুইটা। আব্বা সারাবছর পুকুরের মাছের যত্ন নিতেন। বন্যা এসে পুকুর ডুবিয়ে দিতো। প্রথমে কারেন্ট জাল দিয়ে পুকুরে বেড়া দেয়ার চেষ্টা করা হতো। পানি আরো বাড়তো। আব্বা হাল ছেড়ে দিতেন। মন খারাপ করে বলতেন, 'পরের বছর তেলাপিয়া চাষ করবো। তাড়াতাড়ি বড় হবে। বন্যা আসার আগেই সব মাছ ধরে ফেলবো।'
একবার পানি এসে ঘরে ঢুকে গেলো। মারাত্মক বন্যা হয়েছিলো। 'পুরান বাড়ি'তে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আবছা আবছা মনে আসে সেই ঘটনা। ছোট ঘর ছিলো পুরান বাড়িতে। সেখানে অনেক মানুষ উঠেছিলাম। ৩০/৩৫ জন।
যেদিন পানি বাড়লো সেদিন বিকালে আব্বা অফিস থেকে আসছিলেন। রাস্তায় তিনি ছিলেন একা। পানির স্রোত আব্বাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো হাওরের মাঝে। সামনেই ছিলো নদী। সেই ক্ষরস্রোতা নদীতে পড়লে আব্বা মরে যেতেন। নদীর খুব কাছে যাওয়ার পরেই একটা নৌকা এসে আব্বাকে তুললো।
আব্বা আমার জন্য শার্ট কিনেছিলেন। হাতে ছিলো শার্টের ব্যাগ। আব্বা বাঁচলেন, কিন্তু শার্ট ভেসে গিয়েছিলো।
আব্বা মাঝে মাঝে সেই ঘটনার কথা বলেন। আমার শার্টের রঙ ছিলো নীল। পকেটে বোতাম ছিলো। আব্বার হুবুহু মনে আছে।
৪।
চাচার জানালার বাইরে রক্তজবা গাছ ছিলো। সারাবছর টকটকে লাল ফুল ধরতো।
জানালার পাশে বসে আমি চাচার কাছে পড়তাম। টেবিল না, আমরা পড়তাম বিছানায়। লেপ মুড়ি দিয়ে।
চাচা খুব রাগী ছিলেন। একবার অংক না পারায় চাচা আমাকে লেপ সহ জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। আমি পড়েছিলাম রক্তজবা গাছের উপরে।
বিল্ডিং বানানোর জন্য যখন রক্তজবা গাছটি কেটে ফেলা হয় তখন খুব মন খারাপ হয়েছিলো।
৫।
একটা কুকুর ছিলো। অনেকগুলো বাচ্চা দিতো প্রতি শীতে। আমার খুব খাতির হয়ে যেতো বাচ্চাগুলোর সাথে। তারপর একটা একটা করে বাচ্চাগুলো মরে যেতো।
একটা সাদা রঙের বাচ্চা পেছনের দুই পা নাড়াতে পারছিলোনা। সারাদিন শুয়ে থাকতো। আমাদের মন খারাপ হতো। আমি আর আব্বা সেটাকে খাবার দিতাম প্রতিদিন। কোনো উন্নতি হলোনা। এক পর্যায়ে খাবারের সাথে প্যারাসিটামল আর এম্পিসিলিন মিশিয়ে দেয়া শুরু করলাম। ওষুধ দিচ্ছি, নিশ্চয়ই ভালো হয়ে যাবে।
প্রতিদিন সকালে কুকুরটাকে দেখতে যেতাম। ভালো হয়ে গেছে, এই আশা নিয়ে। এক সপ্তাহ চললো। এক সকালে মরে গেলো কুকুরটা। আমাদের আরো মন খারাপ হয়েছিলো। আব্বা আর আমি সকালে খাইনি সেদিন।
৬।
বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি হলে মন খারাপ হয়। মন খারাপ হলে শৈশবের কথা মনে পড়ে। বৃষ্টি ভালো না।
ছোটবেলায় বৃষ্টি হলে খড়ের চাল ফুটা হয়ে যেতো। সেই ফুটা দিয়ে বৃষ্টি আসতো। মা বৃষ্টি থেকে বিছানা বাঁচাতে রান্নাঘর থেকে হাড়ি পাতিল নিয়ে আসতেন। চালের ফুটার ঠিক নিচেই রাখা হতো পাতিল। সেগুলোর ফাঁকে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে যেতাম। পাতিলে টুং-টাং করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তো। আমাদের ঘুম গভীর হতো।
২।
তখন রোজা পড়তো শীতকালে। ধান কেটে নিয়ে আসার পর মাড়াই করা হতো। গরুগুলা ধানের উপর ঘুরতেই থাকতো ঘুরতেই থাকতো। গরুও ক্লান্ত হতো, যারা মাড়াই করছেন তাঁরাও। ইফতারের সময় বসে থাকতো গরুগুলো। বাকিরা ইফতার শেষ আবার ধানের উপর ঘুরা শুরু করতো।
উঠানের কোনায় বসে দাদা কাশতেন, হুক্কা টানতেন আর গল্প করতেন।
দাদা মারা গেছেন তিন বছর হলো। হার্ট অ্যাটাক হয়েছিলো সকাল ৮ টায়। সেদিন ৯ টায় ছিলো এনাটমি প্রফের রিটেন। পরীক্ষা ভালো হয়েছিলো খুব। প্রশ্ন হাতে পেয়ে হেসে দিয়েছিলাম। সব কমন। পরীক্ষা শেষে বের হয়ে কেমন জানি লাগছিলো। দাদা নেই। কী অদ্ভুত! শৈশব পুরোটাই কেটেছে দাদাকে নিয়ে। ১৬ ঘন্টা জেগে থাকলে ১২ ঘন্টাই থাকতাম তাঁর সাথে।
বাড়িতে যাই। মন খারাপ লাগে। বিশেষ করে সন্ধ্যাগুলোতে।
কেউ যে কোথাও নেই—সকলে গিয়েছে মরে—সকলে গিয়েছে চলে—উঠান রয়েছে শুধু একা
শিশুরা কাঁদে না কেউ—রুগিরা হাঁপায় না তো—বুড়োরা কয় না কথা : থুবড়ো ব্যথার কথা যত
এখানে সকাল নাই—এখানে দুপুর নাই—এখানে জনতা নাই—এখানে সমাজ নাই—নাইকো মূর্খ ধাঁধা কিছু
আকাশে চাঁদের আলো—উঠোনে চাঁদের আলো—নীলাভ চাঁদের আলো—এমন চাঁদের আলো আজ
৩।
সবচেয়ে ভালো লাগতো বন্যা আসলে। বিশাল পুকুর ছিলো দুইটা। আব্বা সারাবছর পুকুরের মাছের যত্ন নিতেন। বন্যা এসে পুকুর ডুবিয়ে দিতো। প্রথমে কারেন্ট জাল দিয়ে পুকুরে বেড়া দেয়ার চেষ্টা করা হতো। পানি আরো বাড়তো। আব্বা হাল ছেড়ে দিতেন। মন খারাপ করে বলতেন, 'পরের বছর তেলাপিয়া চাষ করবো। তাড়াতাড়ি বড় হবে। বন্যা আসার আগেই সব মাছ ধরে ফেলবো।'
একবার পানি এসে ঘরে ঢুকে গেলো। মারাত্মক বন্যা হয়েছিলো। 'পুরান বাড়ি'তে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আবছা আবছা মনে আসে সেই ঘটনা। ছোট ঘর ছিলো পুরান বাড়িতে। সেখানে অনেক মানুষ উঠেছিলাম। ৩০/৩৫ জন।
যেদিন পানি বাড়লো সেদিন বিকালে আব্বা অফিস থেকে আসছিলেন। রাস্তায় তিনি ছিলেন একা। পানির স্রোত আব্বাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো হাওরের মাঝে। সামনেই ছিলো নদী। সেই ক্ষরস্রোতা নদীতে পড়লে আব্বা মরে যেতেন। নদীর খুব কাছে যাওয়ার পরেই একটা নৌকা এসে আব্বাকে তুললো।
আব্বা আমার জন্য শার্ট কিনেছিলেন। হাতে ছিলো শার্টের ব্যাগ। আব্বা বাঁচলেন, কিন্তু শার্ট ভেসে গিয়েছিলো।
আব্বা মাঝে মাঝে সেই ঘটনার কথা বলেন। আমার শার্টের রঙ ছিলো নীল। পকেটে বোতাম ছিলো। আব্বার হুবুহু মনে আছে।
৪।
চাচার জানালার বাইরে রক্তজবা গাছ ছিলো। সারাবছর টকটকে লাল ফুল ধরতো।
জানালার পাশে বসে আমি চাচার কাছে পড়তাম। টেবিল না, আমরা পড়তাম বিছানায়। লেপ মুড়ি দিয়ে।
চাচা খুব রাগী ছিলেন। একবার অংক না পারায় চাচা আমাকে লেপ সহ জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। আমি পড়েছিলাম রক্তজবা গাছের উপরে।
বিল্ডিং বানানোর জন্য যখন রক্তজবা গাছটি কেটে ফেলা হয় তখন খুব মন খারাপ হয়েছিলো।
৫।
একটা কুকুর ছিলো। অনেকগুলো বাচ্চা দিতো প্রতি শীতে। আমার খুব খাতির হয়ে যেতো বাচ্চাগুলোর সাথে। তারপর একটা একটা করে বাচ্চাগুলো মরে যেতো।
একটা সাদা রঙের বাচ্চা পেছনের দুই পা নাড়াতে পারছিলোনা। সারাদিন শুয়ে থাকতো। আমাদের মন খারাপ হতো। আমি আর আব্বা সেটাকে খাবার দিতাম প্রতিদিন। কোনো উন্নতি হলোনা। এক পর্যায়ে খাবারের সাথে প্যারাসিটামল আর এম্পিসিলিন মিশিয়ে দেয়া শুরু করলাম। ওষুধ দিচ্ছি, নিশ্চয়ই ভালো হয়ে যাবে।
প্রতিদিন সকালে কুকুরটাকে দেখতে যেতাম। ভালো হয়ে গেছে, এই আশা নিয়ে। এক সপ্তাহ চললো। এক সকালে মরে গেলো কুকুরটা। আমাদের আরো মন খারাপ হয়েছিলো। আব্বা আর আমি সকালে খাইনি সেদিন।
৬।
বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি হলে মন খারাপ হয়। মন খারাপ হলে শৈশবের কথা মনে পড়ে। বৃষ্টি ভালো না।
0 মন্তব্য(গুলি) :
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
পিসি ইউজাররা উপরের(ফেইসবুক কমেন্ট) অথবা নিচের যেকোনো বক্সে কমেন্ট করতে পারেন। আর মোবাইল ব্যবহারকারীরা যে বক্সটি দেখা যাচ্ছে সেটিতে কমেন্ট করুন।