বড় হয়েছি গ্রামে। "আউট বই" পড়ার উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা ছিলো তখন। আমার চাচার পালং-এর নিচে বেশ বড় সড় একটা বাক্স ছিলো। একদিন দেখলাম বাক্সভর্তি বই আর ম্যাগাজিন। আমার মাথায় ভুত চাপলো, যেভাবেই হোক এই বাক্সে একদিন হানা দিতে হবে। বই আর ম্যাগাজিনগুলো দেখতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো বাক্স তালা দেয়া। আমি প্রায়ই চাচার পালং-এর নিচে ঢুকে বাক্সে গুতাগুতি করি কিন্তু সেটা আর খুলতে পারি না। একদিন কিভাবে যেনো চাবি পেয়ে গেলাম। আমি বুকে সাহস সঞ্চয় করে ঢুকে গেলাম পালং-এর নিচে। খুলে ফেললাম বাক্স। অনেক অনেক বই আর রঙ চঙ্গা ম্যাগাজিন।
আমি বিসমিল্লাহ বলে বাক্সে হাত দিলাম।
প্রথমেই পেলাম কিছু চিঠি। পড়ে বুঝলাম এগুলো চাচার প্রেম পত্র। বেশ রসালো জিনিষ। এরপর পেয়েছিলাম সম্ভবত ইউসুফ জুলেখা প্রেম কাহিনি টাইপ কিছু একটা। ঐদিন পালং-এর নিচে বসে প্রেম কাহিনি পড়লাম পুরোটা।
কায়দা করে জেনে গেলাম চাচা বাক্সের চাবি কোথায় রাখেন। এরপর থেকে আমার কাজ হলো স্কুল থেকে এসেই তার পালং-এর নিচে ঢুকে পড়া। ঢুকে পড়াশোনা করা।
মনে আছে অনেক ম্যাগাজিন পেয়েছিলাম। একটু "ইয়ে" টাইপ ম্যাগাজিন।
তখন মনে হয় ক্লাস সিক্সে পড়ি। নিষিদ্ধ জিনিষের প্রতি তীব্র আকর্ষন। এগুলো আমি বেশ মজা করেই পড়ি।
এভাবেই চলছিলো বই পড়া। বাক্সের একদম নিচের দিকে একটা বই পেলাম। নাম "হিমুর রুপালী রাত্রী"। লেখক হুমায়ুন আহমেদ। অনেকটা অনিচ্ছা নিয়ে হাতে নিলাম বইটা। একটা একটা করে পাতা উল্টাচ্ছি। খুব দ্রুত শেষ হয়ে গেলো বই।
শেষ করার পরের অনুভুতিটা ব্যাক্ষা করতে পারবো না জীবনেও। এটা কী পড়লাম আমি! কার লেখা পড়লাম! কী ছিলো এই বইটাতে!
হুমায়ুন আহমেদ নামক মাদকটা সেদিনই গিলে ফেলেছি। এখনও ডুবে এই মাদকের মদকতায়। আমি হলফ করে বলতে পারি এই মাদকতা কখনোই কাটবে না।
হুমায়ুন আহমেদ। এক জাদুকরের নাম।
উপন্যাস, ছোট গল্প, সায়েন্স ফিকশন, প্রবন্ধ, গান, নাটক, চলচ্চিত্র... যেখানে হাত দিয়েছেন সেটাকেই "হুমায়ুনিয়" করে ছেড়েছেন। এভাবে পৃথিবীতে আর কেউ কি পেরেছে? মনে হয় না।
হুমায়ুন আহমেদকে একটি বিপ্লব বললেও ভুল হবে না। বই-এর যায়গা আগে ছিলো উচ্চবিত্তের সাজানো আলমারিতে। সেখান থেকে বইকে তিনি নিয়ে এসেছেন মধ্যবিত্তের বিছানায়, বালিশের পাশে।
আগে যেখানে নাটক মানে ছিলো ব্যাকরণের কচকচানী হুমায়ুন আহমেদ সেখানে নিয়ে আসলেন জীবনবোধ। মানুষ দেখলো নাটকের চরিত্ররা কেবল কল্পনার রাজ্যে থাকে না, কেবল শান্তিনিকেতনী ভাষায় কথা বলে না। তারা সবার মতোই সাধারণ, তারাও কথা বলে সাধারনের মতো।
চলচ্চিত্রেও হুমায়ুন আহমেদ দিলেন নতুন প্রান। হুমায়ুন আহমেদের হাত ধরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র চলে গেলো অন্য এক উচ্চতায়।
গান মানে যে কেবল "আমি তুমি" না সেটাও প্রমান করলেন হুমায়ুন আহমেদ।
লিখলেন বাংলা ভাষার প্রথম বিশুদ্ধ সায়েন্স ফিকশন।
তার প্রবন্ধ মানেও যেনো অন্যরকম জাদু।
বিভিন্ন সময়ে তার কলম হয়েছে অন্যায়ের বিপক্ষে সোচ্চার। বহুব্রিহী নাটকের "তুই রাজাকার" সংলাপটির মাধ্যমে নতুন করে তিনি আবার রাজাকারদের চিনিয়ে দিয়েছেন।
লালন ভাস্কর্য ভাঙ্গার প্রতিবাদ সরুপ বন্ধ করেছেন নিজের নাটক জোছনা ও জননীর গল্প।
সম্প্রতি লিখেছেন "মন্টুর ফাসি" "যোগাযোগ মন্ত্রির পদত্যাগ"।
এই মহান মানুষটাকে ঘিরে আমার খুব আনন্দের একটা স্মৃতি আছে।
কয়েক মাস আগে আমি ডক্টর ইউনুস আর গ্রামিন ব্যাংক ইস্যুতে ব্লগে একটা প্যারোডি লিখেছিলাম- "হিমুর হাতে কয়েকটি নোবেল প্রাইজ"। ঐ লেখাটা ফেসবুকে প্রায় দুই হাজারবার শেয়ার করা হয়েছিলো। ঘটনাক্রমে ওটা পড়েছিলেন হুমায়ুন আহমেদ। পরে আমি জেনেছিলাম স্যার ওটা পড়ে বেশ প্রশংসা করেছিলেন।
জেনে আমি প্রচন্ড আনন্দিত হয়েছিলাম। অনেকে আমার আনন্দ দেখে কপাল কুচকিয়েছিলেন। আমি গায়ে মাখিনি ওসব।
বাংলা সাহিত্যের এই প্রবাদ পুরুষ আমার একটি লেখা পড়েছিলেন। সেই লেখাটা ছিলো তারই সৃষ্ট একটা চরিত্র নিয়ে। এটা আমার মতো এক তরুনের জন্য অনেক আনন্দের ব্যাপার। আমি যতোবারই এটা ভাববো গর্বে আমার বুকের ছাতি ফুলে যাবে কয়েক হাত।
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য হুমায়ুন আহমেদ এখন আছেন নিউ ইয়র্কে। প্রথম যখন শুনেছিলাম স্যারের ক্যান্সার আমার চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি পড়েছিলো। আবার যখন পরে আবার শুনেছিলাম স্যারের ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য তখন আবার আনন্দে চোখ দিয়ে পানি পড়েছিলো।
স্যার, এই লেখাটি আপনি পড়বেন কি না জানি না। তারপরেও বলি, আপনি কি জানেন বাংলাদেশের কোটি মানুষ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে? আপনি কি জানেন আপনি যেদিন আবার সুস্থ হয়ে দেশে ফিরবেন তখন কতো মানুষ আনন্দে কাদবে?
স্যার, জানেন? বাংলাদেশে এখনো জোছনা হয়। বৃষ্টি হয়। মন খারাপ করা সব জোছনা। বিষন্ন সব বৃষ্টি। জোছনা আর বৃষ্টিগুলো আপনার অপেক্ষা করেছে।
আপনিই যে এগুলোকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সবার কাছে। আপনি যখন সুস্থ হয়ে ফিরবেন তখন আবার জোছনা হাসবে, বৃষ্টিও হবে মন ভালো করা।
ফিরে আসুন স্যার। প্লিজ।
লেখাটি আজকের যুগান্তরে প্রকাশিত।
আমি বিসমিল্লাহ বলে বাক্সে হাত দিলাম।
প্রথমেই পেলাম কিছু চিঠি। পড়ে বুঝলাম এগুলো চাচার প্রেম পত্র। বেশ রসালো জিনিষ। এরপর পেয়েছিলাম সম্ভবত ইউসুফ জুলেখা প্রেম কাহিনি টাইপ কিছু একটা। ঐদিন পালং-এর নিচে বসে প্রেম কাহিনি পড়লাম পুরোটা।
কায়দা করে জেনে গেলাম চাচা বাক্সের চাবি কোথায় রাখেন। এরপর থেকে আমার কাজ হলো স্কুল থেকে এসেই তার পালং-এর নিচে ঢুকে পড়া। ঢুকে পড়াশোনা করা।
মনে আছে অনেক ম্যাগাজিন পেয়েছিলাম। একটু "ইয়ে" টাইপ ম্যাগাজিন।
তখন মনে হয় ক্লাস সিক্সে পড়ি। নিষিদ্ধ জিনিষের প্রতি তীব্র আকর্ষন। এগুলো আমি বেশ মজা করেই পড়ি।
এভাবেই চলছিলো বই পড়া। বাক্সের একদম নিচের দিকে একটা বই পেলাম। নাম "হিমুর রুপালী রাত্রী"। লেখক হুমায়ুন আহমেদ। অনেকটা অনিচ্ছা নিয়ে হাতে নিলাম বইটা। একটা একটা করে পাতা উল্টাচ্ছি। খুব দ্রুত শেষ হয়ে গেলো বই।
শেষ করার পরের অনুভুতিটা ব্যাক্ষা করতে পারবো না জীবনেও। এটা কী পড়লাম আমি! কার লেখা পড়লাম! কী ছিলো এই বইটাতে!
হুমায়ুন আহমেদ নামক মাদকটা সেদিনই গিলে ফেলেছি। এখনও ডুবে এই মাদকের মদকতায়। আমি হলফ করে বলতে পারি এই মাদকতা কখনোই কাটবে না।
হুমায়ুন আহমেদ। এক জাদুকরের নাম।
উপন্যাস, ছোট গল্প, সায়েন্স ফিকশন, প্রবন্ধ, গান, নাটক, চলচ্চিত্র... যেখানে হাত দিয়েছেন সেটাকেই "হুমায়ুনিয়" করে ছেড়েছেন। এভাবে পৃথিবীতে আর কেউ কি পেরেছে? মনে হয় না।
হুমায়ুন আহমেদকে একটি বিপ্লব বললেও ভুল হবে না। বই-এর যায়গা আগে ছিলো উচ্চবিত্তের সাজানো আলমারিতে। সেখান থেকে বইকে তিনি নিয়ে এসেছেন মধ্যবিত্তের বিছানায়, বালিশের পাশে।
আগে যেখানে নাটক মানে ছিলো ব্যাকরণের কচকচানী হুমায়ুন আহমেদ সেখানে নিয়ে আসলেন জীবনবোধ। মানুষ দেখলো নাটকের চরিত্ররা কেবল কল্পনার রাজ্যে থাকে না, কেবল শান্তিনিকেতনী ভাষায় কথা বলে না। তারা সবার মতোই সাধারণ, তারাও কথা বলে সাধারনের মতো।
চলচ্চিত্রেও হুমায়ুন আহমেদ দিলেন নতুন প্রান। হুমায়ুন আহমেদের হাত ধরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র চলে গেলো অন্য এক উচ্চতায়।
গান মানে যে কেবল "আমি তুমি" না সেটাও প্রমান করলেন হুমায়ুন আহমেদ।
লিখলেন বাংলা ভাষার প্রথম বিশুদ্ধ সায়েন্স ফিকশন।
তার প্রবন্ধ মানেও যেনো অন্যরকম জাদু।
বিভিন্ন সময়ে তার কলম হয়েছে অন্যায়ের বিপক্ষে সোচ্চার। বহুব্রিহী নাটকের "তুই রাজাকার" সংলাপটির মাধ্যমে নতুন করে তিনি আবার রাজাকারদের চিনিয়ে দিয়েছেন।
লালন ভাস্কর্য ভাঙ্গার প্রতিবাদ সরুপ বন্ধ করেছেন নিজের নাটক জোছনা ও জননীর গল্প।
সম্প্রতি লিখেছেন "মন্টুর ফাসি" "যোগাযোগ মন্ত্রির পদত্যাগ"।
এই মহান মানুষটাকে ঘিরে আমার খুব আনন্দের একটা স্মৃতি আছে।
কয়েক মাস আগে আমি ডক্টর ইউনুস আর গ্রামিন ব্যাংক ইস্যুতে ব্লগে একটা প্যারোডি লিখেছিলাম- "হিমুর হাতে কয়েকটি নোবেল প্রাইজ"। ঐ লেখাটা ফেসবুকে প্রায় দুই হাজারবার শেয়ার করা হয়েছিলো। ঘটনাক্রমে ওটা পড়েছিলেন হুমায়ুন আহমেদ। পরে আমি জেনেছিলাম স্যার ওটা পড়ে বেশ প্রশংসা করেছিলেন।
জেনে আমি প্রচন্ড আনন্দিত হয়েছিলাম। অনেকে আমার আনন্দ দেখে কপাল কুচকিয়েছিলেন। আমি গায়ে মাখিনি ওসব।
বাংলা সাহিত্যের এই প্রবাদ পুরুষ আমার একটি লেখা পড়েছিলেন। সেই লেখাটা ছিলো তারই সৃষ্ট একটা চরিত্র নিয়ে। এটা আমার মতো এক তরুনের জন্য অনেক আনন্দের ব্যাপার। আমি যতোবারই এটা ভাববো গর্বে আমার বুকের ছাতি ফুলে যাবে কয়েক হাত।
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য হুমায়ুন আহমেদ এখন আছেন নিউ ইয়র্কে। প্রথম যখন শুনেছিলাম স্যারের ক্যান্সার আমার চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি পড়েছিলো। আবার যখন পরে আবার শুনেছিলাম স্যারের ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য তখন আবার আনন্দে চোখ দিয়ে পানি পড়েছিলো।
স্যার, এই লেখাটি আপনি পড়বেন কি না জানি না। তারপরেও বলি, আপনি কি জানেন বাংলাদেশের কোটি মানুষ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে? আপনি কি জানেন আপনি যেদিন আবার সুস্থ হয়ে দেশে ফিরবেন তখন কতো মানুষ আনন্দে কাদবে?
স্যার, জানেন? বাংলাদেশে এখনো জোছনা হয়। বৃষ্টি হয়। মন খারাপ করা সব জোছনা। বিষন্ন সব বৃষ্টি। জোছনা আর বৃষ্টিগুলো আপনার অপেক্ষা করেছে।
আপনিই যে এগুলোকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সবার কাছে। আপনি যখন সুস্থ হয়ে ফিরবেন তখন আবার জোছনা হাসবে, বৃষ্টিও হবে মন ভালো করা।
ফিরে আসুন স্যার। প্লিজ।
লেখাটি আজকের যুগান্তরে প্রকাশিত।